জীবনের গল্প-২৩

                   শ্রী নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু)

জীবনের গল্প-২২ শেষাংশ↓↓

জীবনের গল্প-২৩ আরম্ভ↓↓
কানাইর বন্ধু প্রদীপদের বাড়িতে আসার পর যা দেখা  গেলো, তা এই ভারতে পা রাখার আগে অনেক শুনেছি। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। যা ভারতে আসার পর বিশ্বাস করতে হলো। বাংলাদেশে একজন গরিবের বাড়িতেও যদি কোনও অতিথি আসে তাহলে কতনা সমাদর করে। 

অতিথির জন্য রাত আর দিনের হিসাব না করে অতিথিকে সমাদর করাটাই বড় বিষয় হয়ে দাড়ায়। আর এখানে রাত হয়েছে বলে যত যন্ত্রণা! কিছু খাও আর না খাও, সকালবেলা চলে যাও! 

এসব দেখে আমি ভাবছিলাম, যার কাছে যাব, সে যদি এমন করে?  তাহলে কোথায় যাব? কানাইর কাছেও ক’দিন থাকব! বড় দিদির বাড়ি গেলে, বড় দিদি যদি আমাকে দেখে বিরক্ত হয়? তাহলে যাবো কোথায়? চাকরি যদি মনোমত না হয়, তাহলে? 

এমন আরও অনেক অনেক প্রশ্ন নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম! একসময় সকাল হল। সময় তখন ভোর ৫টা। সূর্য মামা তখনও উঁকি দেয়নি। আমারা অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলাম, তাই সবাই তখনও ঘুমে বিভোর। 

সেসময় প্রদীপের মা এসে সবাইকে ডেকে বলছে, “ওঠো, ওঠো গো বাবা সকল। সকাল ৫টা বাজে। তোমরা যখন শিয়ালদা যাবে, সকাল পৌনে ছয়টার সময় একটা ট্রেন আছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। ট্রেনটা ধরতে পারলে নিরি-বিলি যেতে পারবে।“

প্রদীপের মায়ের কথা শুনে আমি ওঠে কানাইকে বললাম, “এই কানাই, তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নে। ছয়টা বাজতে আরো ৪৫ মিনিট বাকি আছে, ট্রেনটা হয়ত ধরতে পারব।”

কানাই কুরমুড়ি দিয়ে ওঠে ওর দু’বোনকে ঘুম থেকে ওঠাল। প্রদীপদের বাড়িতে আর কিছু খাওয়া হল না। চলে আসলাম দমদম রেলস্টেশনে। স্টেশনে এসে একটা চা-দোকানে সবাই চা-বিস্কুট খেয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। 

এরপর কানাই তাড়াতাড়ি করে স্টেশনের ভেতরে গিয়ে চারটে টিকেট কিনল। ট্রেন আসার পর সবাই ট্রেনে গিয়ে বসলাম। ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছালো সকাল ৮টায়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো রিজার্ভ করলাম। 

অটো দিয়ে যাচ্ছি  আর দেখেছি সেখানকার ১৪০০ বঙ্গাব্দ, বর্ষবরণ উৎসবে সাজানো রাস্তার আশ-পাশ। মনে হয়েছিলো, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, মহল্লায়-মহল্লায় এখানে-সেখানেই বর্ষবরণের আয়োজন হয়েছিলো। 

কোথাও-কোথাও বৈশাখী লোকজ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চও দেখা গেলো। অটো চলল প্রায় ৩০ মিনিটের মতো। নামলাম বাঘ যতীন রেলস্টেশনের বিপরীতে এক মহল্লায়। সেখান থেকে একটু পায়ে হেঁটে গেলাম কানাইর ভাড়া করা বাসায়।

এই জায়গাটার নাম বাঘা যতীন কেন হলো তা কানাইর কাছে জানতে চাইলাম। জবাবে কানাই বলল, “এই বাঘা যতীনের বাড়ি ছিল আমাদের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। বাঘা যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা দিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল বলে, তার নাম রটে যায় বাঘা যতীন।

“এখানে থেকেই নাকি বাঘা যতীন লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি একসময় হয়ে উঠেছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের সম্মুখ যুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন। কিছুদিন বালাসোর হাসপাতালে থাকার পর অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর একসময় ভারত ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঘা যতীন স্মরণে জায়গার নাম রাখা হয় বাঘা যতীন।” 
বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সন্ধান করলেও বাঘা যতীন-এর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। 

এই বাঘা যতীন এলাকার কানাই তখন স্থায়ী বাসিন্দা। ও আরও অনেক আগে থাকেই যেই বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িওয়ালার ঘরেই কানাই খাওয়া-দাওয়া করে। কানাই থাকে একা। কিন্তু এখন কানাইর সাথে আরও তিনজন দেখে বাড়িওয়ালার মাথায় হাত। এখন কানাইকে কিছু বলতেও পারছে না, আবার সইতেও পারছে না।

আমি সেটা ভালো করে ফলো করতে লাগলাম। তাদের এমন ভাবটা বোঝা যেতো তখন, যখন খাবার খেতে যেতাম। সেখানে দুইদিন থাকার পর কানাইকে বললাম, “আমাকে রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নিয়ে চল। এখানে তোর সমস্যা হচ্ছে।”
তখন কানাই বলল, “যাবো আরো দুইদিন পরে। আগে তোকে কোলকাতা শহরটা একটু দেখাই। ওখানে গেলে-তো আর সহা-শিগগির আসতে পারবি না। তাই কিছু সুন্দর-সুন্দর জায়গা দেখে যা, চিনেও যা।”
বললাম, ”আচ্ছা ঠিক আছে, তা-ই হবে।”
কানাইর কথায় আর অমত করেনি। দুইদিন কানাইর সাথে শুধু ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। 

এদিকে রতন চক্রবর্তীর স্ত্রীর ভারত আসার কথা ছিলো,   আমাকে সুন্দর একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু না, তিনি আর আসছে না। কানাইও তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এই অপেক্ষার মধ্যে কেটে গেল আরও দুইদিন। 

এর এক ফাঁকে আমি নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে একটা চিঠির খাম (এনভেলপ) কিনলাম। নিরিবিলি সময়ে একটা চিঠি লিখে পাঠালাম, আমার স্ত্রীর ঠিকানায়। চিঠিতে  জানিয়ে দিলাম, আমি মঙ্গল মতো কলিকাতা পৌঁছেছি। চিঠি পাঠালাম এই কারণে যে, আমার জন্য যেন কোনও প্রকার চিন্তা না করে, তাই। তারপর ঘুরেফিরে কেটে গেল আরও বেশকিছু দিন। আমার চিন্তাও বাড়তে লাগল!

এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা কানাই বলল, “চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি?” 
কানাই বলল, “আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।”

এ-তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল। চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ। এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাইর বাসা থেকে একটা রিকশায় চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। রিকশা থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। 

আমি সিগারেট জ্বালিয়ে টানছি আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে। কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে কী?”
কানাই বলল, ”এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।
বললাম, “তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?” কানাই বলল, ”হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। চল এখন নিচে স্টেশনের ভেতরে। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!”
সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে গেলাম। স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হলাম!   

এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা  পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা  শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়। 

জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো ভূতলস্থ এবং উড়াল; এই তিন প্রকারেই স্টেশনই রয়েছে। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছি, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর! ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট। 

কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান। ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ”শিগগির আয়।”

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল।  যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, “টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।”
আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, “যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।”

এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রিদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে। 

ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং। 
বলা হচ্ছে, “আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।”

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। ট্রাম দেখা হলো, ট্রামে চড়াও হলো।

ট্রাম হলো কোলকাতা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা। এটি এ দেশের প্রথম ও একমাত্র পরিসেবা প্রদানকারী ট্রাম। জানা যায়, এটি এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা। এই ট্রাম পরিসেবা প্রথম চালু হয়েছিল, ১৮৭৩ সালে। শোনা যায়, প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে না-কি ট্রাম চালানো হতো। এই ট্রাম কিন্তু ঝুলন্ত ট্রাম নয়! এ হলো রোড ট্রাম। যা বাস রোডের পাশ দিয়ে চলে। 

এই ট্রাম চলার রাস্তা হলো রেললাইন। ট্রাম দেখতে হুবহু রেলগাড়ির মতনই। তবে ট্রেনের মতো এত চওড়া নয়, সামান্য চিকন। বগি থাকে দুইটি, ড্রাইভার একজন। কন্ট্রাক্টর একজন। এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়া যায়। যাত্রী যেখানে খুশি, সেখানেই ওঠানামা করতে পারে। এই রোড ট্রামও চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। তবে চলে আস্তে-আস্তে।

ট্রামে চড়ে আসলাম ধর্মতলা। এবার যাব রানী ভিক্টোরিয়া পার্কে। এই ভিক্টোরিয়া পার্কটি ছিল যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাণীর নামে। রানী ভিক্টোরিয়া ১ মে ১৮৭৬ সালে ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি ধারণ করেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতেই, তার নামে ‘রানী ভিক্টোরিয়া’ পার্ক নির্মাণ করেন ভারত সরকার। 

পার্কটি খুবই সুন্দর! পার্কের মাঝখানে আছে রানী ভিক্টোরিয়া ভাস্কর্য। প্রতিদিন বিকালবেলা এই পার্ক থাকে লোকে লোকারণ্য। পার্কের গেটের সামনে বসে হরেকরকমের দোকান। যেন আমাদের দেশের এক বৈশাখী মেলার মতো। দেখলাম ভিক্টোরিয়া পার্ক। রানী ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বাইর হলাম সন্ধ্যার একটু আগে। এ দিন তারামণ্ডল দেখার আর সুযোগ হল না। চলে এলাম কানাইর বাসায়। কানাই বলল, “আজ যখন তারামণ্ডল দেখা হল না, তা হলে আগামীকাল দেখব।”

রাতের খাবার খেয়ে দুইজনে শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠলাম। তখন মনে হয় বেলা ১০ টার মতো বাজে। ঝটপট দুইজনে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করলাম। দিনটি ছিল রবিবার। ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাড়াতাড়ি না গেলে, তারামণ্ডল আজও দেখা হবে না। কারণ, ছুটির দিনে তারামণ্ডলে লোক অনেক বেশি হয়। 

কানাই আমাকে নিয়ে বের হলো তারামণ্ডল দেখানোর জন্য। এটি হলো দক্ষিণ কোলকাতার জওহরলাল নেহেরু রোডে। এর পাশে আছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। এটি হলো মহাকাশচর্চা কেন্দ্র ও প্ল্যানেটরিয়াম জাদুঘর। নাম রাখা হয়েছে, এমপি বিড়লা তারামণ্ডল। 

এই তারামণ্ডলটি সাঁচীর বৌদ্ধ স্তুপের আদলে নির্মিত, একটি একতলা ভবনে অবস্থিত। শোনা যায়, এই প্ল্যানেটরিয়ামটি এশিয়ার বৃহত্তম প্ল্যানেটরিয়াম। এটি ছাড়াও নাকি ভারতে আরও দুটি তারামণ্ডল আছে। একটি চেন্নাইতে, অপরটি হায়দ্রাবাদে অবস্থিত।

আমি যখন ভারতে গিয়েছিলাম, তখন তারামণ্ডলের ভেতরে যাওয়া বাবদ প্রবেশ মূলা ছিল ২টাকা। তারামণ্ডলের ভেতরে গেলাম। দেখলাম তারামণ্ডল। ভেতরে যাবার পর আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় আছি! ইউটিউবে বা টিভিতে যেভাবে মহাকাশের দৃশ্য দেখি, ঠিক সেই ভাবেই দেখছি!

তারামণ্ডল থেকে বাইর হলাম দুপুরবেলা। দুপুরের খাবারের সময় হওয়াতে গেলাম এক হোটেলে। ভাত মাছ আর মুগের ডাউল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। দুইজনের খাবারের বিল হলো, ৩০ টাকা। হোটেল থেকে বাইর হয়ে আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “এবার কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “জীবনে তো হাওড়া ব্রিজের অনেক কেচ্ছা-গিবত শুনেছিস! এবার বাস্তবে দেখে যা।”
বললাম, “চল, হাওড়া ব্রিজটা দেখি!”

সেখান থেকে ট্রামে চড়ে গেলাম, হাওড়া। হাওড়া ব্রিজের সামনে যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। ব্রিজে ওঠতেই আমার চোখে পড়ল, ব্রিজে লাগানো একটা সাইনবোর্ডের দিকে। সাইনবের্ডের লেখা আছে, এই ব্রিজটির নির্মাণকাল ও কিছু নির্দেশনা। ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রক্ষার জন্যও জনগণের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।

জানা যায়, হাওড়া ব্রিজটি উনিশ শতকের অন্যতম নিদর্শনের একটি। এটি হুগলি নদীর উপর অবস্থিত। এটি কোলকাতা ও হুগলি শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতু। এই হাওড়া ব্রিজ ছাড়াও হুগলি নদির উপর আরও  ব্রিজ আছে। সেগুলির মধ্যে এই হাওড়া ব্রিজ হলো অন্যতম। 

এটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একমাত্র ভাসমান ঝুলন্ত  সেতু। ব্রিজটি সম্পূর্ণ লোহার এঙ্গেল ও নাট-বল্টু দ্বারা তৈরি। এর মাঝখানে কোনও পিলার বা খুঁটি নেই। দেখে মনে হয় এটি যেন মাধ্যাকর্ষণের শক্তিতে ঝুলেছে। ব্রিজটি নির্মাণের পর একবার এক স্টিমারের নোঙর ছিঁড়ে ব্রিজের সাথে সংঘর্ষ হয়। এর ফলে ব্রিজটির মাঝখানের বেশকিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে ব্রিজটি পুনঃনির্মাণ করে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই হাওড়া ব্রিজটির বিজ্ঞপ্তি নোটিশে লেখা আছে, ব্রিজটি ১,৫২৮ ফুট দীর্ঘ। এর প্রশস্ত লেখা না থাকলেও বোঝা যায়, ব্রিজটি প্রশস্ত ৪০ থেকে ৫০ ফুট হবে। ব্রিজটির মাঝখানে আছে যানবাহন চলাচলের জায়গা। দুই পাশে মানুষ চলাচলের জন্য ৬ থেকে ৭ ফুট প্রশস্ত রাস্তা। 
চলবে...

ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা