জীবনের গল্প-৩০
জীবনের গল্প-২৯ শেষাংশ↓↓
জীবনের গল্প-৩০ আরম্ভ↓↓
আমার বড়দি'র বাড়িতে দুইজন ব্যাচেলর থাকতো। ওদের বাড়ি ছিলো মেদিনীপুর। ওরা বীর পাড়ায় অবস্থিত একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে চাকরি করতো।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ওই দুইজন ছেলের সাথে ঘুমানোর জায়গা হলো। পরদিন সকাল বেলা বড়দি আমাকে ঘুম থেকে জাগালো। বেলা তখন সকাল দশটার মতো বাজে। তখন ভাড়াটিয়া ছেলে দুটোও ঘরে ছিলো না। ওরা সকাল আটটার সাথে সাথেই ওদের কাজে চলে গিয়েছিল।
দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “ওখানেও কি তুই এতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠিস?”
বললাম, “না দিদি, অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তো, তাই একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলো।”
এরপর ঘুম থেকে উঠে স্নানঘর থেকে হাত-মুখ ধুলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে বের হলাম, বীরপাড়া বাজারের উদ্দেশে।
বীরপাড়া বাজারে গিয়ে বাজারে শেষ মাথায় একটা চায়ের দোকানের সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি ভুটান ভুটান বলে জীপ গাড়ির হেলপাররা চিল্লাচিল্লি করছে। তা শুনে ভুটান যাবার জন্য আমার মনটা আনছান আনছান করতে লাগলো।
আমার বড়দি'র বাড়ি থেকে ভুটানের গুমটু'র ভাড়া ছিলো মাত্র ৩টাকা। দুরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। যানবাহন বলতে ছিলো জীপগাড়ি। মনে সাহস রেখে এদিক-সেদিক না তাকিয়ে গেলাম ভুটানের গুমটু এলাকায়। বিকাল পর্যন্ত ঘুরে-ফিরে দেখে আবার দিদির বাড়ি ফিরে আসি।
আবার ক'দিন পর গেলাম ভুটানেরই একটা জায়গায়। জায়গাটার নাম ফুলসিলিং। আমার বড়িদি'র বাড়ি থেকে ফুলসিলিঙের ভাড়া ২০ টাকা। দুরত্ব অনেক। আবার আরেকদিন গেলাম ভুটানের সামসি এলাকায়। মোটকথা বীরপাড়া এলাকার চারদিকে থাকা ভুটানের সব এলাকার ঘুরে-ফিরে দেখতে দেখতে একসময় আমার পকেট ফাঁকা হয়ে গেলো।
শেষমেশ উপায়ন্তর না দেখে আমার মেজো ভাগনার সাথে গাড়ির গ্যারেজে হেলপার হিসেবে কাজ করতে থাকি। বেতন পেতাম প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় টাকা মাত্র ১০০/= টাকা। সপ্তাহে এই নামমাত্র ১০০/=টাকা হাতে পেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিনিশ করে আবার পকেট শূন্য হয়ে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করতে হতো। এরপর আবার পকেট গরম করার জন্য আশায় থাকতাম রবিবারে অপেক্ষায়।
এভাবে থাকতে থাকতে বীর পাড়ায় কাটিয়ে দিলাম প্রায় এক বছরের মতো। একসময় দেখলাম আমার বড়দি, জামাইবাবু-সহ ভাগিনা-ভাগ্নিরাও কেমন যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যখন-তখনই দেখতাম তাদের চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব। তারপর নিজে নিজেই বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম।
নন্দলাল নামে একজন লোকের সাহায্য নিয়ে বর্ডার পাড় করার দালাল খুঁজতে লাগলাম। বর্ডার পাড় করার দালালও পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশে আসার মতো কোনও টাকার ব্যবস্থা ছিলো না।
তারপর তিনমাস পর্যন্ত পকেট খরচ কমিয়ে দিয়ে আসার খরচ জোগাড় করেছিলাম। আমি যে বিগত তিনমাস যাবত আসার প্রস্তুতি নিয়ে চলছিলাম, তা আর দিদির বাড়ির কাউকে জানতে দেইনি।
যেদিন বড়দি'র বাড়ি থেকে বাংলাদেশ চলে আসবো, তার আগের দিন রাতে বড়দি'র কাছে বলেছিলাম, “আগামীকালই আমি বাংলাদেশ চলে যাবো।”
আমার কথা শুনে বাড়ির সবাই হায়-হুতাশ শুরু করে দিলো। বলতে লাগলো, “কী ব্যাপার, কী হয়েছে, আগে বলিসনি কেন? আগামীকালই কেন যাবি? আরও কয়েকদিন থেকে যা” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি কারোর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সোজা ব্যাচেলর ছেলে দুটোর সাথে শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের যাকিছু ছিলো, সেগুলো ব্যাগের ভেতরে ভরতে লাগলাম।
বড়দি সামনে এসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো, “সত্যি তুই এখনই রওনা দিচ্ছিস?”
বললাম, “হ্যাঁ দিদি, আমি এখনই রওনা হবো।”
জামাইবাবু থাকতে বললো, ভাগিনারা থাকতে বললো। কিন্তু না, আমি আর কারোর কথা শুনলাম না।
হাতমুখ ধুয়ে জামা-প্যান্ট পরে যখন ব্যাগ কাঁধে তুললাম, তখন জামাইবাবু বললো, “একটু দেরি করো আমি বীরপাড়া বাজার থেকে আসছি।”
এই বলেই কামাইবাবু তাড়াতাড়ি বাইসাইকেল নিয়ে সোজা বীরপাড়া বাজারের উদ্দেশে রওয়ানা দিলো। আমি আর জামাইবাবু কথায় গুরুত্ব দিলাম না, আশেপাশে থাকা বাড়ির সকলের কাছ থেকে বলে-কয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে সোজা মেইন রোডের দিকে হাঁটা ধরলাম।
উদ্দেশ্য গ্যারেজ লাইনে গিয়ে আমাকে সাহায্যকারী নন্দলাল'র কাছে যাবো। তারপর গ্যারেজ লাইনের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দালালের বাড়ির ঠিকানায় রওনা দিবো।
এই উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে বড়দি'র বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। আমার পেছনে বড়দি-সহ অনেক মহিলারা গ্যারেজ লাইন মেইন রোড পর্যন্ত আসলো। জামাইবাবুও বীরপাড়া বাজার থেকে বাড়ি এসে আমাকে না দেখে গ্যারেজ লাইনে এসে কাঁধের ব্যাগ টেনে ধরলো। জামাইবাবু নিজের হাতেই ব্যাগের ভেতরে একটা শাড়ী কাপড়, আর এক পিস জামার কাপড় ও এক পিস প্যান্টের কাপড় ভরে দিলো।
কিছুক্ষণ পর নন্দলাল আসলে দুইজনে রওনা হলাম বর্ডার এলাকায়। ভারত-বাংলাদের বর্ডার এলাকা হলো রংপুর বুড়িমারী স্থলবন্দর। ভারতের ভেতরে বর্ডার এলাকায় গিয়ে সোজা চলে গেলাম দালালের বাড়ি। দালাল ছিলো নন্দলাল'র আগে থেকে পরিচিত।
আমার সাথে টাকার অংক ছিলো ভারতীয় ২,৮০০/= টাকা। ভারতীয় দালালের সাথে কথা হলো আমাকে বর্ডার পাড় করে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেওয়া। বিনিময়ে দালালকে দিতে হবে ভারতীয় ৬০০/=টাকা। তারপর আমার কাছে থাকা ভারতীয় টাকা থেকে দালালকে ৬০০/= টাকা দিয়ে বাদবাকি ২,২০০/=টাকা ভাঙানো হলো।
তারপর নন্দলাল আমাকে দালালের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে উনি উনার গন্তব্যে চলে গেলো। আমি থেকে যাই দালালদের বাড়িতে। কথা ছিলো কিছুক্ষণ পরই বর্ডার পাড় করে আমাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। ওরা আরও যাত্রী সংগ্রহ করার জন্য আমাকে তাদের ঘরে একরকম বন্দি করে রাখলো।
সকাল ১১টা থেকে বিকাল পর্যন্ত যখন আর কোনও যাত্রী সংগ্রহ করতে পারছিলো না, তখন আমার সাথে থাকা টাকাগুলো জোর করে কেড়ে নিয়ে গেলো। এমনকি বড়দি'র দেওয়া শাড়ি, জামার কাপড়, প্যান্টের কাপড়-সহ আমার আরও ব্যবহারিক জামা কাপড়গুলো ছিনিয়ে নিলো।
এরপর রাতের আঁধারে বাংলাদেশের ভেতরে এনে একটা বাড়ির পেছনে রেখে বললো, “এখানে একটু দাঁড়ান, আমরা বাংলাদেশের দালালের সাথে কথা বলে আসি।” আমি নিরুপায় হয়ে তাদের কথামতো ওই বাড়ির পেছনেই দালালদের জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু না, তারা আর আসলো না! ওরা আমাকে ওই বাড়ির পেছনে রেখেই পালিয়ে গেলো।
আমি তখন নিরুপায় হয়ে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভয় ভয় মনে বাড়ির ভেতরে গিয়ে কেউ আছেন বলে ডাক দিলাম। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে কয়েকজন নারী-পুরুষ বের হলো। আমি ছিলাম বাড়ির উঠানে দাঁড়ানো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “কে আপনি? এখানে এতো রাতে কী করে এলেন? কোথায় যাবেন?”
তাদের কথার জবাবে সবকিছু খুলে বললাম। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছিলো না। কেউ বলতে লাগলো, “বিডিআর খবর দিয়ে তাদের হাতে উঠিয়ে দিতে।”
ওই বাড়ির একজন মুরুব্বি বললো, “লোকটা দুষ্কৃতকারী হবে।”
আবার দুইএক জন বললো, “না, দুষ্কৃতকারী হলে এভাবে এখানে আসতোই না।”
তারপর তাদের মধ্যে একজন আমার ব্যাগ সহ সারা শরীর তল্লাশি শুরু করে দিলো।
তল্লাসি করে কিছুই যখন পায়নি, তখন ওদের একটু মায়া মায়া ভাব হলো। আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। ভাত নেই, একমুঠো চাল ভেজে সামনে এনে দিল। খেতে পারলাম না। এক গ্লাস জল পান করে বসে রইলাম রাত পোহানোর আশায়।
রাত শেষে সকাল হলো। ওরা আমাকে বাংলাদেশের বুড়িমারী স্থল বন্দর নিয়ে এলো। ওরা আমাকে বুড়িমারী একটা বাস কাউন্টার দিখিয়ে দিয়ে চলে গেল। বিনিময়ে আমার হাতের ঘড়িটা ওরা নিয়ে গেলো।
আমি ধীরেসুস্থে বাস কাউন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাস কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় যাবেন?”
বললাম, “দাদা আমিতো যাবো ঢাকা। তবে আমি দুর্ঘটনার শিকার!”
বললেন, “কোথায় এবং কীভাবে?”
সবকিছু খুলে বললাম। ম্যানেজার সাহেব শুনলেন। আমাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়ালেন। ঢাকা পর্যন্ত একটা সিট দিয়ে দিলেন। সাথে ১০০ টাকাও দিলেন। কনট্রাক্টরকে বলে দিলেন, “রাস্তায় কিছু খাবার কিনে দিতে।”
গাড়ি ছাড়ল সন্ধ্যার সময়। ঢাকা গাবতলি পৌঁছলাম সকাল ৮ টায়। গাবতলি থেকে আসলাম সদরঘাট। লঞ্চে চড়ে গেলাম, আমার শ্বশুরবাড়ি। যাওয়ার সময় ছেলে-মেয়েদের জন্যও কিছু কিনে নিতে পারিনি, গেলাম খালি হাতে। তবুও আমাকে দেখে আমার ছেলে-মেয়ে দুটো খুবই খুশি। বলতে লাগলো, “আমাদের বাবা এসেছে।” অথচ আমি ভারত গেলাম বড় আশা করে। আর দেশে ফিরলাম নিঃস্ব হয়ে।
যাইহোক, শ্বশুরবাড়িতে দুইদিন ঘোরাফেরা করে কাটালাম। তারপর তাদের বাড়ির নিকটে সুবচনী বাজারের পাশে সান স্লিক টেক্সটাইল মিলে চাকরি নিলাম। সেখানে কিছুদিন চাকরি করে আবার চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জ।
চাকরি নিলাম আগে কাজ করা মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে। একসময় ছেলে-মেয়ে দুটোকে স্কুলে ভর্তি করালাম। মেয়ে এসএসসি পাস করার পর ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে গোপালগঞ্জের এক ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম।
একমাত্র ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ২০১১সালের ২০ মে হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলো। ছেলের রেখা যাওয়া Nokia c-3 মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেটের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লাম।
একসময় ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নামে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে নোকিয়া মোবাইলে ইংরেজি অক্ষরে লিখে একটা লেখা জমা দিলাম। সময়টা তখন ২০১৫ সাল।
কিন্তু ওই ব্লগে ইংরেজি লেখা প্রকাশ করা হয় না। আমিও দীর্ঘদিন ব্লগে চুপি দিই না। অনেকদিন পর ওই ব্লগে চুপি দিয়ে দেখি আমার ইংরেজি অক্ষরের লেখা বাংলা করা হয়েছে এবং লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে।
কিন্তু নোকিয়া মোবাইলে তো বাংলা লেখা যায় না। আমার অবস্থা তখন “কী করি ভেবে মরি" এই অবস্থার মতো। তারপর আমি যাদের কাজ করতাম, তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার-কর্জ করে একটা সিম্ফনি এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে ওই ব্লগে জমা দেওয়া লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখলাম, "আমিও মানুষ"।
এরপর লেখা প্রকাশ হলো। লেখায় অনেক ব্লগাররা মন্তব্য করলো। সেসব মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়েই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ, ফেসবুক -সহ অনলাইন ভিত্তিক দিনলিপি গুলোতে নিয়মিত লেখালেখির সাথে মিশে গেলাম।
একসময় ২০১৭ সালে ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে সবার সহযোগিতায় সম্মাননাও পেয়েছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি অভাবী সংসারের একবেলা খাবার না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হয় আমার মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকলে আর লেখালেখি করতে না পারলে।
বর্তমানে এই লেখালেখিই যেন আমার অবশিষ্ট জীবনের নিশ্বাস। মনে হয় লেখালেখি বন্ধ হবে তো আমার নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই শত চেষ্টা করেও লেখালেখি বন্ধ করতে পারছি না। শত কষ্টের মাঝেও কিছু-না-কিছু লিখেই যাচ্ছি।
কিন্তু আমার এই নগন্য লেখা কে পড়লো আর কে পড়লো না, সেদিকে আমি ফিরে তাকাই না। আমি লিখেই যাচ্ছি, আমার শহরের গল্প, দুখী মানুষের গল্প আর আমার চলিত জীবনের গল্প। সমাপ্ত:
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com