জীবনের গল্প-২১
জীবনের গল্প-২০ শেষাংশ↓↓
জীবনের গল্প-২১ আরম্ভ↓↓
দুইদিন পরই ভারত যাবার দিন-তারিখ ঠিক করা হলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিবো, ২৭ চৈত্র ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ, ১০ এপ্রিল ১৯৯৩ ইং রবিবার। রাত পোহালেই রবিবার। সকালবেলা বড়দা’র বাসায় নাস্তা সেরে জামাকাপড় পড়ে রেডি হচ্ছিলাম।
জামাকাপড় পড়তেই বড়দাদা জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাবি?”
আমি বললাম, “আমি কানাইদের বাসায় যাচ্ছি। আজই মনে হয় রওয়ানা দিতে পারি। আমার জন্য আশীর্বাদ রাখবি।”
বড়দাদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “এখনই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিবি নাকি?”
বললাম, “না, যেতে যেতে হয়তো সন্ধ্যা হতে পারে। তো একটু আগেই যাচ্ছি, কানাইর সাথে কিছু কাজ আছে।”
আমার কথা শেষ হলে বড়দাদা আমার হাতে ৫০০/=টাকা দিলে বললো, “যা, ভগবানকে স্মরণে রেখে দেখে-শুনে চলবি।”
অবশ্য বড় দাদাকে এর আগেও ভারতের ব্যাপারে বিস্তারিত খুলে বলেছিলাম। তাই হয়তো বড়দাদা আগে থেকেই আমার জন্য কষ্ট করে হলেও ৫০০/=টাকা রেখে দিয়েছিল। তাই ওই ৫০০/=টাকা যাবার দিন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল।
বড়দা'র কাছ থেকে ৫০০/=টাকা নিয়ে দাদার বাসা থেকে বের হলাম, কানাইদের বাসার উদ্দেশ্যে। কানাইদের বাসায় গেলাম। তখন প্রায়ই দুপুর হয়ে গিয়েছিল। কানাইদের বাসায় চলছে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। কানাইর মা আমাকেও খেতে দিলেন। সবার সাথে বসে আমিও দু’মুঠো খেলাম।
খাওয়াদাওয়া শেষে কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, “সাথে টাকাপয়সা কিছু এনেছিস?”
বললাম, “হ্যাঁ আছে কিছু! তা হাজার খানিক হবে।” কানাই বলল, “তা চলবে। ওখানে গেলে তো আর টাকার অভাব হবে না। আমি নিজেই তোকে মাসেকখানি চালাতে পারব।”
কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “রওনা দিবি কয়টা বাজে?” কানাই বলল, “যেই গাড়ি করে আমরা যাবো, সেই গাড়ির সুপারভাইজার এই মহল্লারই। সুপারভাইজার আসলেই আমরা রওনা দিব।”
এরপর সন্ধ্যা হবার সাথে-সাথে কানাই-সহ ওর দুই বোন আর আমি রেডি হয়ে আছি বাসের সুপারভাইজারের অপেক্ষায়। সন্ধ্যার একটু পরেই বাসের সুপারভাইজার কানাইদের বাসায় আসলো। কয়জন যাবে এবং কী কী সাথে নেওয়া হবে, তার একটা বিবরণ জেনে নিলো। এর কিছুক্ষণ পর সবাই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা-গাবতলি। সেখান থেকে উঠালাম কেয়া পরিবহনে। যাওয়া হবে বেনাপোল বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে। বর্ডার পার হয়ে ভারত। বেনাপোল যেতে যাতে রাত ভোর হয়ে গেলো। বাস থেকে নামলাম সকাল ৭ টায়।
বাসের বেশিরভাগ যাত্রীদেরই ছিল বৈধ পাসপোর্ট। ছিল না শুধু আমাদের ক’জনের।পাসপোর্ট না থাকলেও কোনও সমস্যা নেই, সাথে আছে বিনা পাসপোর্টে ভারত পাঠানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুপারভাইজার। বাস টার্মিনালে যাওয়ার সাথে-সাথেই বর্ডার পাড় করার দালাল রেডি।
সুপারভাইজার দালালের কাছে আমাদের চারজনকে বুঝিয়ে দিলেন। দালালকে পাড় করার বিনিময়ে দিতে হবে, জনপ্রতি ২০০ টাকা। দালালের সাথে কথা পাকা-পাকি হয়ে গেল বাস কাউন্টারের ভেতরেই।
এরপর সাথে নেওয়া জিনিসপত্রের ব্যাগগুলো আর আমাদের বহন করতে হয়নি; যা করার দালালের লোকজনই করেছে। দালালদের ভ্যানগাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল দালালদের বাড়িতে।
দালালদের বাড়ি ভারত বর্ডার সংলগ্ন। মনোরম পরিবেশ আর সৌন্দর্যময় জায়গা। অন্যান্য গাছ-গাছালির মধ্যে সেখানে বাঁশগাছই বেশি। বাসস্ট্যান্ড থেকে যাওয়ার সময় দেখা যায়, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়েই রাস্তা। রাস্তাও বেশ সুন্দর, আঁকা-বাঁকা চিকন রাস্তায় বাইসাইকেলের ছড়াছড়ি।
আমরাও চারজন চারটা সাইকেলে চড়েই যাচ্ছিলাম। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, আর এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখছি। দেখে মনে হলো এ-যেন সাইকেলের রাজত্ব। বেনাফুল বর্ডার এলাকায় যার কিছুই নেই, তার একটা বাইসাইকেল মনে হয় অবশ্যই আছে।
ওখানকার দৈনন্দিন জীবন চলার একমাত্র সঙ্গী হল, বাইসাইকেল। বেনাপোল বর্ডার সংলগ্ন মানুষের হাটবাজার, মালামাল পরিবহণ-সহ সবকিছুই বাইসাইকেলের ওপর নির্ভর। সাইকেল দিয়েই নেওয়া হচ্ছে বর্ডার পারা-পারের যাত্রীদের।
সময়-সময় বর্ডার নিরাপত্তায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কড়া নজরদারিও থাকে। সেসময় পাসপোর্ট বিহীন মানুষকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। ওইরকম সমস্যায় পড়ে গেলাম আমরাও। বর্ডার ক্লিয়ার নাই, তাই। বর্ডার সংলগ্ন দালালদের বাড়িতেই বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছিল তিনদিন।
তিনদিন বন্দি থাকার পর যেদিন বর্ডার পার হবো, সেদিন বিকালবেলা দালাল এসে আমাদের জানিয়ে দিল আজই বর্ডার পার করা হবে। ঠিক তা-ই হল। সন্ধ্যার সময়ই দালালদের তাড়াহুড়ো বেড়ে গেল। সেদিন ঝামেলা একটু কম হয়েছে আমাদের। কারণ, সেদিন আমরা চারজন ছাড়া ভারত যাবার যাত্রী আর কেউ ছিল না। তাই মনে হলো বর্ডারে তিনদিন বন্দী থাকার মূল কারণই ছিলো, যাত্রী সংগ্রহ করার একটা চালাকি।
কিন্তু এই তিনদিনের মধ্যে একজন যাত্রীও সংগ্রহ করতে না পেরে শেষমেশ আমাদের নিয়েই রওনা দিলো। আমাদের সাথে দালালরা চারজন। ওরা আমাদের সাথে নিয়ে রাতেরবেলা পায়ে হেঁটে বাঁশ ঝড়ের চিপাচাপা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। দালালরাও ছাঁটছে, আমরাও দালালদের পিছুপিছু হাঁটছি।
দালালরা হাঁটছে আর বলছে, এখন বর্ডার উত্তপ্ত! খুব সাবধানে হাঁটবেন। কোনও আওয়াজ করবেন না। আজকে লাল সিগনাল। বিএসএফ-এর কড়া নজরদারি। ওদের কথা শুনে বুঝতে আর অসুবিধা হলো না যে, এসব হলো ভুয়া! আমাদের ভয় দেখানোই ছিলো ওদের বাহানা। ওরা দালালরা খুবই স্বার্থবাদী। টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না।
বর্ডারে তিনদিনের কষ্টের কথা মনে পড়লেই আমার শরীর এখনও শিউরে ওঠে। তিনদিন আটকা থাকা অবস্থায়, দালালদের ঘর থেকেও আমাদের বের হতে দেয়নি। শুধু ভয় আর ভয় দেখিয়েই আমাদের বন্দিশালায় বন্দী করে রেখেছিলো। এই তিনদিনে দালালদের কোনও কথার অবাধ্য হতে পারিনি।
কোনোকিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে গেলেও সম্মুখে বিপদ দেখা যেতো। বর্ডারে তিনদিন খুব কষ্ট করে ছিলাম। তিনদিনের থাকা খাওয়ার খরচও দালালদের দিয়েছিলাম। ওদের কর্কশ ব্যাবহারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। শেষমেশ তিনদিন পর তাদের কথামত সেদিন সন্ধ্যার পর রাতেরবেলা গেলাম একটা খালপাড়ে।
বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে যখন খালপাড় গেলাম, তখন খালে কোনও নৌকা ছিল না। রাতের জোৎস্নার আলোতেই পথ চলছি দালালদের সাথে আমরা চারজন। তখন খালের স্বচ্ছ পানিতে দেখা যায়, জোৎস্নার ঝিকিমিকি। খালের প্রস্থতা কম হলেও খালটি ছিল দেখতে খুবই সুন্দর।
খালের উঁচু দুই পাড়েই গাছগাছালি ভরা। শেনেছিলাম ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে কাটাতারের বেড়া থাকে। কিন্তু খালপাড়ে কাটা তারের বেড়া নেই। খালের ওপারেই ভারত বর্ডার সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ক্যাম্প। রাত তখন আনুমানিক ৮টা, নিরব নিস্তব্ধ এক জনশূন্য এলাকা।
দালালদের একজন মুখ দিয়ে খুব জোরে একটা শিশ দিল। শিশ দেওয়ার সাথে-সাথে দুইজন লোক-সহ একটা নৌকা আসল। দালালরা বললো, “তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকায় উঠেন। আর নৌকার মাঝিকে ২০০ টাকা দিয়ে দিবেন। ওপারে যাওয়ার পর, নৌকার মাঝিই সব ব্যবস্থা করে দিবে।“
আমরা নৌকায় গিয়ে উঠে বসলাম। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই দেখা যায়, দুইজন লোক দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীদের অপেক্ষায়। নৌকার মাঝি লোক দুইজনকে ভালো করে বলে-কয়ে বুঝিয়ে দিলো। যেন যাওয়ার সময় কোন প্রকার অসুবিধা না হয়। দশ মিনিট পরই ওপার গিয়ে নৌকা ভিড়ল।
নৌকার মাঝিকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে, নৌকা থেকে নামলাম। পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ ১৯৯৩ ইংরেজি ভারতের মাটি স্পর্শ করলাম। নৌকা থেকে নেমেই ভারতের দালাল ওই দুইজনের সাথে আবার হাঁটতে লাগলাম। যেই দুইজন দালালদের সাথে আমরা যাচ্ছি, তাদেরও দিতে হবে জনপ্রতি ১০০/=টাকা করে, ৪০০/=টাকা। তাদের কাজ হলো, বনগাঁ যাওয়ার গাড়ীতে উঠিয়ে দেওয়া।
হাঁটতে লাগলাম বাঁশ ঝাড় আর সবজি ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। চারিদিকে শুধু বাঁশগাছ আর সবজি খেত। সবজি খেতের মাঝখান দিয়েই পথ। রাতের জোৎস্নার আলোতেই হাঁটতে লাগলাম, ভারতের দালালদের সাথে। বাড়িঘর খুব একটা নেই। ভারতের বর্ডার এলাকায় বেশিরভাগ জায়গাই ফসলি জমি।
আছে কদ্দুর পর-পর বিএসএফ এর ক্যাম্প আর দু’একটা বাড়ি। আমার খুব ভয়-ভয় লাগছিলো, যদি বিএসএফ এর ছোঁড়া গুলি গায়ে এসে লাগে? সেই ভয়ে আমি কাঁপছি আর হাঁটছি। দালাল-সহ আমরা যাচ্ছিলাম খুব সাবধানে।
প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর, শোনা যাচ্ছে গাড়ির শোঁ-শোঁ শব্দ। আমি তখন মনে মনে প্রভুকে ডাকছি, “হে প্রভু! তুমি রক্ষা কর!”
এভাবেই একসময় একটা পাকা সড়কের সামনে সবাই এসে দাঁড়ালাম।
বনগাঁ যাবার গাড়ি আসার আগেই ভারতীয় দালালদের ৪০০/= টাকা বুঝিয়ে দিলাম। বনগাঁ যাবার গাড়ি আসতেই দালাল হাত নেড়ে সিগনাল দিল। গাড়ি থামল। দালাল দুইজন আমাদের সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো বাসে উঠিয়ে দিল।
বাস ২০ মিনিট চলার পর বনগাঁ পৌঁছে গেলো। বাস থেকে সবাই নামলাম বনগাঁ রেলস্টেশনের সামনে। আমরা যাব শিয়ালদা। ট্রেন ছাড়বে রাত ১০ টায়। রেলস্টেশনের সামনে যখন গেলাম, তখন রাত ৯ টা। শিয়ালদা যাবার ট্রেন ছাড়তে আরও একঘণ্টা বাকি। এই একঘণ্টা বনগাঁ রেলস্টেশনেই বসে থাকতে হচ্ছে।
এদিকে অনেক পথ হেটে আসার পর আমার অবস্থা কাহিল! আমি পেটের ক্ষুধায় কাতর হয়ে গিয়েছিলাম। বড্ড খিদা লেগেছিলো আমার। বাস থেকে নামার পর বনগাঁ রেলস্টেশনের সামনে থাকা খাবারের দোকানগুলো দেখে আমার পেটের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেলো!
আমি কানাইকে বললাম, “হে রে কানাই! এখান থেকে কিছু খেয়ে নিলে হয় না? আমার খুব খিদে পেয়েছে রে!'
আমার সাথে তাল মিলিয়ে কানাইর দু’বোনও কানাইকে বলল, “সত্যি দাদা, খুব খিদে লেগেছে! কিছু খেয়ে নিলে ভালো হয়।”
কানাই বলল, “এখানে কিছু এদিক-সেদিক ব্যাপার আছে! সবাই একসাথে যাওয়া যাবে না। সবাই একসাথে গেলেই বিপদে পড়তে হবে। আর নানারকম ঝামেলাও হবে। কারণ, এখানকার মানুষ খুবই চালাক! আমাদের দেখেই বুঝে ফেলবে আমারা বাংলাদেশি। তখন হয়ত পুলিশের ঝামেলায়ও পড়তে পারি।”
কানাইর দু’বোন বলল, “তা-হলে কী কিছু খাওয়া যাবে না?”
কানাই বলল, “আগে স্টেশনের ভেতরে যাই, পরে দেখা যাবে।”
আমি বললাম, “তা-হলে চল, স্টেশনের ভেতরেই যাই!” সাবাই আস্তেধীরে রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ভেতরে গিয়ে নিরিবিলি এক জায়গায় সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো রাখলাম। এরপর কানাই আমাকে বলল, “তুই ব্যাগগুলোর সামনে একটু দাঁড়া, আমি ওদের নিয়ে হোটেলে যাই। ওদের নিয়ে আসার পর, তোকে নিয়ে আবার বাইরে যাব।“
আমি বললাম, “যা, একটু তাড়াতাড়ি আসবি।”
কানাই স্টেশনের বাইরে যাবার আগে বলল, “কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বুঝে শুনে জবাব দিবি। আর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে, কোথায় যাবেন? তা-হলে বলবি, শিয়ালদা যাব। যদি জিজ্ঞেস করে কোত্থেকে এসেছেন? তাহলে বলবি, বনগাঁ হাই স্কুলের পূর্বপাড় থেকে এসেছি। বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে বলবি, আপনার এতো দরকার কী? উল্টো তাকেই প্রশ্ন করবি, আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি কোথায় যাবেন? এখানে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তা-হলে দেখবি, প্রশ্নকারী ব্যক্তি তোর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এদেশ হল শক্তের ভক্ত, নরমের যম, বুঝলি।”
কানাই ওর দু’বোনকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে গেল কিছু খেতে। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো আমার পাশে। আমার ভেতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। আমি ভয় ভয় মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। স্টেশনে থাকা ট্রেনের টিটিকে দেখলেও আমার শরীর ছমছম করছিলো। কারণ, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সাথে নেই পাসপোর্ট। ধরা পড়লেই প্রথমেই আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধী!
একবার ধরা খেলে আর রক্ষা নাই। যদি ধরা পড়ে যাই, দেশে রেখে আসা দুটো সন্তানের দশা কী হবে? ওদের কে দেখবে! স্ত্রীর কী গতি হবে? বিনা পাসপোর্টে কেন-ই-বা আসলাম! না আসলেও তো হতো। আমার চিন্তার শেষ নেই! কানাইও আসছে না। সিগারেটে অভ্যস্ত লোক আমি। সাথে একটা সিগারেটও ছিলো না।
আমি যেন একটা মহাসাগরের মাঝখানে পড়ে আছি। কিন্তু আমার ধারেকাছে একটা লোকও ছিলো না। আমিই পুরো বনগাঁ রেলস্টেশনের ভেতরে একা বসে আছি। আর মনে মনে ভাবছি! কানাই আসছে না কেন? ওরা কি পুলিশের হাতে ধরা পড়লো নাকি!
এমন অনেককিছু ভাবতে-ভাবতে একসময় কানাই ওর দু’বোনকে নিয়ে হাজির হল। ওদের দেখে আমার যেন প্রাণ ফিরে এলো। মনের চিন্তাও দূর হলো। আমার তখন সাহস হচ্ছিল। এতক্ষণ ভয়ে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
আমাকে একা রেখে বাইরে গিয়ে কানাইও আমার কথা ভাবতেছিল, ”যদি কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে। আর যদি আমি উল্টাপাল্টা কিছু যদি বিলে ফেলি? তাহলে তো মহা বিপদ। ভারতের পুলিশের হল রাজার হাল! তাদের সহজে দেখা যায় না। আবার কাউকে ধরলে আর ছুটানো যায় না। আবার ভারতে বাটপারের অভাব নেই। সব জায়গায়, সবখানে বাটপারদের রাজত্ব। যদি কোনও বাটপারের কবলে পড়ি?”
এমন চিন্তা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে কানাই চলে এলো।
কানাই এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি রে? ভয়ে ছিলি নাকি? আমি তো তোর জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। তুই এখানে নতুন! তোর ভাষাও বাংলাদেশী। কথা বললেই ধরা খাওয়ার জোগাড়! আবার কোনও জায়গার নামও জানিস না। এসব চিন্তা করে আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এখন বল, তোকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?”
বললাম, ”আরে না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আর জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতাম। তবে তোদের আসতে দেরি দেখে আমি নিজেই একটু চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম, যদি কোনও বিপদে পড়িস, তা-হলে তো মহাবিপদ হবে। এখন তোদের দেখে একটু ভালো লাগছে। এতক্ষণ শরীরটা অস্থির লাগছিল। এবার আমাকে কিছু খাওয়া? আমার খুব খিদা পেয়েছে রে।'
আমার কথা শুনে কানাই বলল, “এখন-তো এখানে ওদের একা রেখে স্টেশনের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি! তুই বরং একা গিয়েই ঝটপট কিছু খেয়ে আয়। ওখানে আটার রুটি, চা-বিস্কুট সবই আছে। তুই তাড়াতাড়ি যা। ঝটপট না করলে সমস্যা হবে। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসবে। ট্রেন আসলে আর বেশি দেরি করে না। যাত্রী উঠতে নামতে যতক্ষণ দেরি, ততক্ষণই। কারেন্টের ট্রেন। হুইসেল দিলেই ছুটলো। তুই যা তাড়াতাড়ি করে কিছু খেয়ে আয়।”
কানাইর সাজেশন মাথায় রেখে আমি ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিন চেয়ে রেলস্টেশনের বাইরে যাচ্ছিলাম।
চলবে...
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com