জীবনের গল্প-২৫

                    শ্রী নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু)

জীবনের গল্প-২৪ শেষাংশ↓↓

জীবনের গল্প-২৫ আরম্ভ↓↓
কিন্তু কানাই আবার আমাকে নিয়ে মিলের ভেতরে গিয়ে সুপারভাইজার বাবুকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের এখানে তাঁতের কাজ ছাড়া ‘ব’ গাঁথার কোনও লোক লাগবে কি না?“
সুপারভাইজার বাবু বললো, “আমি আপনার কথা বুঝে ওঠতে পারছি না যে, ‘ব’ গাঁথা কাকে বলে?“
কানাইকে চুপ রেখে আমি সুপারভাইজার বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, শানা এবং বয়ার ভেতর দিয়ে সুতা ভরার কাজটাকে আপনারা কী বলেন?”

আমার কথা শুনে সুপারভাইজার বাবু বললো, “ওহ! বুঝেছি বুঝেছি, ওটাকে আমরা রেসিং বলি। আর যিনি এই কাজটা করে থাকে, তাকে বলি রেসিংম্যান।“
বললাম, “আমার এই কাজটাও জানা আছে। যদি আপনার এখানে এই কাজের লোক না থাকে, তাহলে আমাকে এই কাজটা দিতে পারেন।”

সুপারভাইজার বাবু হেসে বললো, “দুঃখিত! এই কাজটা এলাকার একজন লোকে করে। আর আপনি তো এই কাজ এখানে করতে পারবেন না। কেননা, আপনার তো হেলপার নেই। এই কাজ করতে হলে আগে দরকার হেলপার। কিন্তু আপনার তো তা নেই! তাহলে কাজটা করবেন কী করে?”
আমি আরও জিজ্ঞেস করলাম, “থাক এই কাজও আমার দরকার নেই!  এখন শুনি আপনাদের এখানে তাঁতিদের মজুরি দিয়ে থাকেন কীভাবে?”
সুপারভাইজার বাবু বললো, “প্রতি এক গজ কাপড় বুননকারিকে ৬০ পয়সা মজুরি দিয়ে থাকি।”
আমি আবার  জিজ্ঞেস করলাম, “একজন তাঁতিকে কয়টা করে মেশিন চালাতে দেন?”
সুপারভাইজার বাবু বললো, “দুইটার বেশি মেশিন কেউ কি চালাতে পারে? আর পারলেও আমরা দেই না। কারণ, বেশি মেশিন দিলে বুননের সময় কাপড় খারাপ করে ফেলে, তাই।”
আমি সুপারভাইজার বাবুকে বললাম, “আমাদের বাংলাদেশে একজন তাঁতি অন্তত ৬ থেকে ৮ টা করে মেশিন চালায়।”

আমার কথা শুনে সুপারভাইজার বাবু মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরলো! চেয়ারে বসে বসে আমার দিকে আর কানাইর দিকে শুধু তাকাচ্ছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন সুপারভাইজার বাবু বোবা হয়ে গেছে। 

সুপারভাইজার বাবুর এই অবস্থা দেখে কানাই বললো, “কি স্যার কিছু  বলছেন না যে? আমারা তাহলে এবার আসি?”
সুপারভাইজার বাবু বললো, “দেখুন, আপনারা দিল্লি চলে যান। অনেক টাকা কামাতে পারবেন। ওখানে অনেক উন্নতমানে কাপড় তৈরির মেশিন আছে। সেসব মেশিন আপনাদের জন্যই দরকার। এখানে কাজ করে আপনাদের কখনোই পোষাবে না। এখানে যারা তাঁত চালায়, তাদের সকলের বাড়িই মিলের আশেপাশে। তাদের কোনরকম বাজার করার টাকা হলেই হলো। সেটা তো আপনাদের বেলায় চলবে না দাদা। আপনাদের চাই ভালো টাকা বেতনের চাকরি।”
সুপারভাইজার বাবুর কথা শুনে আমি বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়!”

এরপর মিল থেকে বের হলাম। তখন রাত প্রায় ৮ টার মতো বাজে। কানাই বললো, “সর্বনাশ হয়েছে রে! এতো রাত হয়ে গেল, একটু টেরও পেলাম না। চল শিগগির ফুলিয়া রেলস্টেশনে। রাত ৯টায় একটা ট্রেন আছে, সেটা না ধরতে পারলে বিপদই হবে।”

এরপর দু'জনে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। গেলাম  কোলকাতা-টু-শিলিগুড়ি মেইন রোডে। হাইওয়ে পার হয়ে গেলাম ফুলিয়া রেলস্টেশনের সামনে। তখন রাত ৯ টা বাজতে ৩০/৩৫ মিনিট বাকি আছে। আমার খুব ক্ষিদেও পেয়েছে। কিন্তু কানাইকে কিছু বলতেও পারছি না যে, কানাই আমার ক্ষিদে পেয়েছে। 

আমার অবস্থা দেখে কানাই বুঝতে পেরেছে যে, আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। কানাই আমাকে বললো, ”ট্রেন আসতে এখনও সময় আছে, চল কিছু খেয়ে নিই।” কানাইর কথা শুনে আমি খুবই খুশি হয়ে বললাম, “আমিই তোকে বলতাম যে, আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে! তার আগেই তুই বলে ফেললি? এখন চল একটা চা দোকানে যাই, ঝটপট কিছু খেয়ে নিই।”

গেলাম একটা চা দোকানে। আবারও নিলাম দুইটা পাউরুটি আর দুই কাপ চা। চা খেতে না খেতেই শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল। আমি কেবল পাউরুটিটা অর্ধেক খেয়েছিলাম। হুইসেল শোনার পর আর খেতে পারিনি। তাড়াতাড়ি করে চা টা গিলে রুটিটা পকেটে ভরলাম। দোকানদারকে চা-রুটির টাকা দিয়ে দে দৌড়। 

আমার মতো কানাইরও একইরকম অবস্থা ছিলো! দুইজনেই স্টেশনের দিকে দৌড়াচ্ছি। আসলাম স্টেশনে। কানাই বুকিং-এ গিয়ে শিয়ালদার টিকিট নিল দুইটা। ওঠলাম ট্রেনে। রাত ১১টার সময় পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। এদিন বাসায় যেতে রাত হয়েছিল প্রায় ১ টা।

কানাই'র ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখি বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ!  কানাইর দু’বোন রাতে বাড়িওয়ালাদের ঘরে থাকে। কানাই'র বোনদের সমবয়সী বাড়িওয়ালার একটা মেয়ে আছে। রাতেভকানাই'র দু'বোন সহ ওরা তিনজন এক সাথেই ঘুমায়। 

দোতলা বাড়ি। রাত ১১টার পরপরই দোতলায় উঠার সিঁড়ির গেইটটা বন্ধ থাকে। তাই কানাই'র দু'বোনকেও ডাক দেওয়ার কায়দা নেই। আমার পেটের ক্ষুধার জান যায় যায় অবস্থা। এখন খাবো কী, সেই চিন্তায়ও শরীর অস্থির! 

ওমনি ফুল প্যান্টের পকেটে হাত পড়লো। দেখলাম অর্ধেক পাউরুটি প্যান্টের পকেটে। পাউরুটি ছিলো ফুলিয়া রেলস্টেশন থেকে কেনা। ট্রেনের হুইসেল শুনে তাড়াতাড়ি করার সময় আর পাউরুটি পুরোপুরি খাওয়া হয়নি। খাওয়ার বাকি যতটুকু ছিলো, তা ফুল প্যান্টের পকেটে ভরে দৌড় দিয়েছিলাম, ট্রেন ধরার জন্য। সেই অর্ধেক পাউরুটিই ছিলো সেই রাতের খাবারের সম্বল। 

যাই হোক, দুইজনে হাত-মুখ ধুলাম। কানাইকে বললাম, “কানাই, এখন কী খাব রে?"
কানাই বললো, “কী আর খাব! এখন দুইজনে কুয়োর জল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকি। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে দোকানে গিয়েই খাব।”
আমি হেসে বললাম, “শুধু জল খাব কেন? সাথে পাউরুটিও খাব!”
কানাই বলল, “এতো রাতে তুই পাউরুটি পাবি কোথায়? একটা দোকানও খোলা নেই! আমার একটুও মনে ছিলো না যে, বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকবে। মনে থাকলে আসার সময়ই শিয়ালদা থেকে কিছু সাথে করে নিয়ে আসতাম। যাক, তা আর আফসোস করে লাভ নেই! জল খেয়েই শুয়ে থাকি।”

কানাইর কথা শেষ হতে না হতেই আমি পকেট থেকে অর্ধেক পাউরুটি বের করলাম। রাখলাম কানাইর সামনে বিছানার উপরে। অর্ধেক পাউরুটি দেখে কানাই বলল, “সে-কি-রে? ফুলিয়ার পাউরুটি? পুরোটা খাসনি? দেয় কদ্দুর, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।”
শেষতক তা-ই হলো! অর্ধেক পাউরুটি থেকে অর্ধেক-অর্ধেক করে খেয়ে, দুইজনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে আমি একটু দেরি করে উঠলাম। কানাই উঠেছে আমার আগে। কানাই এখানে আসার পর ও-আর কাজে যায়নি। কানাই ভারতে মহল্লায়-মহল্লায় ফেরি করে কাপড় বিক্রি করে। অনেকদিন পর আজ মহল্লায় যাবে বলে মনস্তাপ করেছে। ও প্রতিদিন সকালে বের হয়। আসে সন্ধ্যার পর। এতক্ষণ সময় আমি কী করবো, কোথায় যাবো, এসব নিয়ে কানাই থাকে খুব চিন্তায়! 

আমি ঘুম থেকে ওঠেই দেখি কানাই মহল্লায় যাবার জন্য ভ্যানগাড়িতে কাপড় ওঠাচ্ছে। আমি বললাম, “কিরে! কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “অনেকদিন হলো মহল্লায় যাওয়া হয় না। তাই ভাবছি আজ মহল্লায় যাবো। না গেলেও হয় না। হাত একেবারেই খালি।”
বললাম, “তা হলে আমাকেও সাথে নিয়ে যা। ঘুরে দেখে আসি তোর ব্যবসা আর বেচা-কেনা।”
কানাই বলল, “না তুই বাসায় থাক! আমি তাড়াতাড়ি করেই বাসায় ফিরে আসবো। যাচ্ছি শুধু কিছু বাকি টাকা আদায় করার জন্য।”
বললাম, “একটু দাঁড়া, আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিই, তারপর একসাথে বের হবো।”

তা-ই হলো। আমি হাত-মুখ ধোয়া পর্যন্ত কানাই রাস্তায় অপেক্ষা করছে। আমি সাধারণ বেশে বাসা থেকে বের হলাম। 

সামনে যেতেই কানাই বলল, “চল সামনের চা-দোকান থেকে দুইজনে চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। আবার কখন-না-কখন আসি, তার কি ঠিক আছে?”
বললাম, “চল চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। আর আমার তো  এমনিতেই চায়ের খুব অভ্যাস।”

কানাই-সহ চা-বিস্কুক খেলাম। কানাই চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে রওয়ানা দিল মহল্লায়। আমি এখন একা এক অচেনা দেশে কাঙাল মানুষ। এখানে এখন আর আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত কেউ নেই। কানাই মহল্লায় যাবার পর আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ভাবছি বাসায় না গিয়ে টাউন গিয়ে ঘুরাফেরা করি। 

কিন্তু টাউনের অলি-গলিও আমার কাছে অপরিচিত। আবার ভাবছি, হোক অপরিচিত, তাতে কি হয়েছে? আমি চলবো আমার মতে। যেথায় খুশি সেথায় যাবো। কিন্তু যাবো কোথায়? এখন সকাল মাত্র ১০টা বাজে। এসব ভাবতে-ভাবতে একা-একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এ সময় একটা অটোরিকশা (সিএনজি) এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবেন দাদা? ধর্মতলা যাবেন? আসেন।”

অটোরিকশার ভেতরে দুইজন যাত্রী বসা। তারাও হয়ত ধর্মতলাই যাবে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। তাই অটোরিকশার ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করল, “কি দাদা, যাবেন?”
বললাম, “হ্যাঁ যাবো। তো আপনি গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবেন? আমি কিন্তু ধর্মতলাই যাবো।”
ড্রাইভার বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ দাদা, আমারও ধর্মতলা পর্যন্তই শেষ। আসেন আসেন গাড়িতে উঠুন।”

উঠলাম অটোতে। অটো চলছে। আমি অটোতে বসে মনে মনে বলছি, “সেদিন কানাইর সাথে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়োর মধ্যে ভালো করে ঘুরে দেখা হয়নি। আজ আমি একা। সাথে টাকাও আছে। আশা করি কোনও সমস্যা হবে না। মনটাও বেশি ভালো লাগছে না। দেশের কথা মনে পড়ছে। আমার বড়দিদির বাড়ি জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। কীভাবে যেতে হয় তাও জানা নেই। এখানে যদি কাজের কোনও ব্যবস্থা না হয়, তা হলে তো বড়দিদির বাড়িতেই যেতে হবে। জলপাইগুড়ি বড়দিদির বাড়ি গেলে দিদি আমাকে চিনবে কি না? যদি না চিনে? যদি তার ওখানে আমাকে থাকতে না দেয়? তা হলে যাবো কোথায়?”

একসময় অটো ধর্মতলা পৌঁছালো। অটো থেকে নেমে ড্রাইভারকে ভাড়া দিলাম ৬ টাকা। ধর্মতলা হলো কোলকাতা শহরের এক ব্যস্ততম জায়গা। এখান থেকেই ভারতের বিভিন্ন শহরে যাবার বাস সার্ভিস। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। দেখছি! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি! সামনেই একটা চা-স্টল। 

বসলাম সামনে থাকা একটা চেয়ারে। দোকানদার জিজ্ঞেস করল, “কী খাবেন দাদা? চা বানিয়ে দিবো?”
 বললাম, “হ্যাঁ দাদা, ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে দিন।”
দোকানদার আমার দিকে বারবার তাকিয়ে-তাকিয়ে কি যেন ফলো করছে। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। চা বানিয়ে সামনে এনে দিয়ে বললো, “দাদা বাবুর বাড়ি কোথায়? কোথা-ই-বা যাবেন?”
এরপর দোকানদার আমার সামনে এসে বসল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা-পান করতেই, আবার বলল, “কোথায় যাবেন?”
বললাম, “কোথাও যাবো না দাদা। এসেছি একটু ঘুরতে।”

চায়ের দোকানে আমি ছাড়া তখন আর কোনও কাস্টমার ছিল না। দোকানদার আমাকে আবারও করলো, “আপনাকে দেখে ভারতের মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় আপনি জয় বাংলার লোক। এখানে আপনার কে থাকে? আমিও কিন্তু জয় বাংলার লোক, দাদা। আমাদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলায়। এখানে আমরা অনেক পুরানো। আমার জন্মও এই ভারতেই। জয় বাংলায় কোনও দিন যাওয়া হয়নি। তাই জয় বাংলার লোক দেখলেই মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে দাদা।”

দোকানদারের কথা শুনে আমি বললাম, “আমার বাড়ি ও দেশ, দুটোই বাংলাদেশে। এখানে এসেছি আমার এক বন্ধুর সাথে। এসেছি একটা কাজের আশায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি দাদা। এবার দেশে ফিরে যাবার পালা। হয়ত দু’একদিনের মধ্যেই দেশে চলে যাব। তাই আপনাদের কোলকাতা শহরটা একটু দেখতে এসেছি।”

আমার কথা শুনে দোকানদার বলল, “এখানে আপনার বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই?”
বললাম, “আছে দাদা, তা তো অনেক দূরে! সেই জলপাইগুড়ি। সেখানে আমার আপন বড় বোনের বাড়ি। তবে দাদা, কীভাবে যে যেতে হয়, তাও আমার জানা নেই।”
দোকানদার বললো, “জলপাইগুড়ি? কীভাবে যাবেন? যেদিন যাবেন, সেদিন আমার সাথে দেখা করবেন। আমি আপনাকে জলপাইগুড়ির বাসে উঠিয়ে দিবো। এই তো জলপাইগুড়ি বাসস্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে। একটু সামনে গেলেই দেখবেন, উত্তরবঙ্গের সকল জেলায় যাওয়ার বাস।”

দোকানদারের কথা শুনে আমি হেসে বললাম, “আচ্ছা দাদা, ঠিক আছে। আমি যেদিন জলপাইগুড়ি যাবো, সেই দিন আপনার সাথে দেখা করে যাবো। এই নিন, আপনার চা-সিগারেটের দাম রাখুন।”
পাঁচ টাকার একটা নোট হাতে দিতে গেলেই দোকানদার রাগ হয়ে আমাকে বললো, “যান তো দাদা, জলপাইগুড়ি যেদিন যাবেন, সেদিন দিবেন। এখন এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে যাবার সময় আবার এক কাপ চা পান করে যাবেন।”
দোকানদার চায়ের মূল্য আর নিল না, আমিও তাকে জোর করেও দিতে পারলাম না!

চলে গেলাম, উত্তরবঙ্গের বাসস্ট্যান্ডের সামনে। একটা টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানলাম, জলপাইগুড়ি বীরপাড়ার ভাড়া কত? ভাড়া ২৬০ টাকা। বীরপাড়া যেতে সময় লাগবে ২০ ঘণ্টার মতো। এখন আর আমার ভালো লাগছে না, শুধু বড়দিদির বাড়ি যাবার চিন্তাই করছি! 

এদিকে দুপুর হয়ে গেছে বহু আগেই, অথচ আমার খবর নাই। এই দিন ধর্মতলার অনেক জায়গায় ঘুরা-ঘুরি করেছি। তাই কখন যে দুপুরের সময় হয়ে গেছে, একটু খেয়ালও করতে পারিনি। আবার একটা অটো করে বাঘা যতীন কানাই'র বাসার সামনে এলাম। বাসায় গিয়ে কানাইর বোন পলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “কানাই কখন আসবে রে?”

পলি বলল, “কখন যে আসে, তা কি ঠিক আছে? আপনি কোথায় গিয়েছিলেন দাদা? আপনাকে অনেক খুঁজেছি, মহল্লার প্রতিটা দোকানে। জিজ্ঞেসও করেছি। কেউ বলতে পারানি। আমরা আপনার জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। কানাইদা কাপড় নিয়ে মহল্লায় যাবার সময় আপনার কথা বলে গিয়েছিল, আপনার দিকে লক্ষ্য রাখতে। লক্ষ্য তো দূরের কথা, আপনার পাত্তাই নেই। দুপুরে কী খেয়েছেন? মনে হয় কিছুই খাননি। এখন তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসেন, ভাত খাবেন।”

পালির কথা শুনে আমি বললাম, “আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসেছি। তোরা খেয়েছিস তো?”
পলি বলল, “এখন বিকাল ৪ টা বাজতে লাগল দাদা, এখনও কি না খেয়ে থাকা যায়? আমরা আপনার বার চেয়ে-চেয়ে এই মাত্র খেলাম।”
বললাম, “বেশ করেছিস! আরও আগে খেয়ে নিতে পারতিস। আমার জন্য শুধু-শুধু কষ্ট করলি? সীমা খেয়েছে? ও এখন কোথায়?“
পলি বলল, “ও খাওয়া-দাওয়া করে এখন ঘুমাচ্ছে।” বললাম, “আমাকে তেলের শিশি আর শাবানটা একটু এনে দে, আমি স্নান করে একটু ঘুমাবো। কানাই আসলে আমাকে ডেকে দিবি।”

পলি শাবান-সহ রেলের শিশি এনে দিল। আমি লেকে গেলাম স্নান করতে। কোলকাতা শহরে বেশি একটা পুকুর নেই। আছে মহল্লায়-মহল্লায় বিশাল-বিশাল লেক। সেখানকার মানুষেরা সবাই লেকে স্নান করে। মানুষের সুবিধার্থে সিটি কর্পোরেশন এই লেকগুলো তৈরি করে রেখেছে। 

আর বেশিভাগ মানুষের বাড়িতে কিছু না থাকলেও একটা কুয়া অবশ্যই থাকে। বাসার প্রতিদিনের ধোয়া-মোছার কাজ ওই কুয়ার জলেই করে থাকে। আমি লেক থেকে স্নান করে এসে বিছানায় গিয়ে শুলাম। শরীর খুব ক্লান্ত! সারাদিন গেল দুই কাপ চায়ের উপর। না খেয়ে থেকেও বললাম, খেয়েছি। 

কারণ, বাড়িওয়ালি কেমন যেন বিরক্ত-বিরক্ত ভাব দেখায়, তাই। বিছানায় শরীরটাকে লেলিয়ে দেওয়ার সাথে-সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কানাই মহল্লা থেকে এসেছে সন্ধ্যাবেলা। কানাই এসেই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল। আমি ঘুম থেকে উঠে বললাম, “কখন এসেছিস?”

কানাই বলল, “এই-তো এলাম! তুই এতো সময় করে ঘুমাচ্ছিস যে? দুপুরে খেয়েছিস?”
বললাম, “হ্যাঁ খেয়েছি। তুই কোথায় খেয়েছিস? কী খেয়েছিস?”
কানাই বলল, “আমি মহল্লায় বেরুলে দুপুরে আর খাওয়া হয় না। এই সামান্য চা-বিস্কুট হলেই হয়ে যায়। এর বেশি কিছু আর লাগে না।”
কানাই ওর ব্যবসার কাপড়গুলো এক সাইট করে রেখে স্নান করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বিছানা থেকে নেমে কুয়োয় গেলাম, হাত-মুখ ধুতে। 

কানাই স্নান করে এসে জামাকাপড় পরে আমাকে বলল, “চল আমার সাথে।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”
কানাই বলল, “ধর্মতলা থেকে একটু ঘুরে আসি।”
বললাম, “আমিতো সকালে একবার ধর্মতলা গিয়েছিলাম। ঘুরেফিরে অনেককিছু দেখে এলাম। জেনেও এলাম।”

আমার কথা শুনে কানাই জিজ্ঞেস করল, “কী দেখে আসলি আর কী জেনে আসলি?”
বললাম, “আমার বড়দিদির বাড়ি জলপাইগুড়িতে কীভাবে যেতে হয়, তা জেনে আসলাম।”
কানাই বলল, “বেশ করেছিস, আমার সাথে চল আমি তোকে পুরো ধর্মতলা ঘুরাবো।”

জামাকাপড় পড়ে কানাই-সহ অটোতে চড়ে গেলাম ধর্মতলা। অটো থেকে নেমেই চা-দোকানদারের সাথে দেখা করলাম। 
কানাইকে বললাম, “এই লোকের বাড়ি আমাদের দেশে ফরিদপুর।”
সকালে চা-দোকানদারের আপ্যায়নের কথাও বললাম। তারপর গেলাম একটা হোটেলে, কিছু খাওয়ার জন্য। কানাই সারাদিন বাইরে ছিল। ওর-ও ভাত খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যায় হোটেলে ঢোকা।
চলবে...

ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা