জীবনের গল্প-২৬
জীবনের গল্প-২৫ শেষাংশ↓↓
জীবনের গল্প-২৬ আরম্ভ↓↓
কানাই হোটেলে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কী খাবি?”
বললাম, “রাতের খাবার তো বাসাই খাবো! এখন আর কী খাওয়া যায় ভাবছি!”
কানাই বলল, “ওইসব কিছু ভাবা দরকার নেই। রাতে বাসার খাবার কপালে জোটে কিনা সন্দেহ আছে। যা খাবার এখান থেকে খেয়ে নে।”
বললাম, “তা জটুক আর না জুটুক, তাতে সমস্যা নেই। এখন হাল্কা পাতলা কিছু খেলেই হবে।”
কানাই বলল, “তাহলে বল, কী খাবি?”
বললাম, “এক প্লেট ভুনাখিচুড়ি খাবো।”
কানাই বলল, “ঠিক আছে তা-ই হবে।”
কানাই হোটেল বয়কে দুই প্লেট ভূনাখিচুড়ি দিতে বললো। কিছুক্ষণ পরই হোটেল-বয় দুই প্লেট ভুনাখিচুড়ি আমাদের সামনে এনে রাখলো। মুগডাল দিয়ে রান্না করা ভূনাখিচুড়ি। সাথে ছোট-ছোট টুকরা করা মুরগির মাংস।
হোটেলটা অনেক বড়!ধর্মতলার মধ্যে এই হোটেটাই সবার কাছে খিচুড়ির জন্য সুপরিচিত। খিচুড়ি খেয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে দুইজনে গেলাম বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, সব বঙ্গের বাসই ছেড়ে যায়।
কানাই উত্তরবঙ্গের বাসের একজন হেলপারের সাথে আলাপ করল। জলপাইগুড়ি বীরপাড়ার ভাড়ার বিষয়ে জানলো। এখান থেকে কখন বাস ছেড়ে যায়, সে বিষয়েও খবর নিলো। এরপর আশে-পাশের অনেক জায়গায় ঘুরা হলো। এই ঘুরা-ঘুরির মধ্যেই রাত হয়ে গেল প্রায় ১০ টার মতো।
এবার বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে অটো খুঁজছিলাম। কিন্তু রাত অনেক হওয়াতে শহরে অটোরিকশাও কমে গিয়েছিলো। যা দু'একটা জুটছে, ভাড়া দ্বিগুণ। বাধ্য হয়ে ডবল ভাড়াতেই অটোতে চাপতে হলো।
ধর্মতলা থেকে অটোরিকশা করে গেলাম বাঘা যতীন। কানাই অটোরিকশা থেকে নেমেই একটা চা-দোকান থেকে দুইটা পাউরুটি কিনল। পাউরুটি কিনল এই কারণে যে, যদি বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকে, তাই।
বাড়ি গেলাম। বাড়ি নীরব। তখন কেউ মনে হয় সজাগ ছিলো না। সবাই ঘুমে বিভোর। দুইজনে কুয়োর পাড় গিয়ে হাত-মুখ ধুলাম। ঘরে এসে জামাকাপড় ছড়লাম। কানাই সাথে নেওয়া পাউরুটি দুটো বিছানার উপর রেখে বললো, “আয় একসাথে বসে খেয়ে নিই!”
বললাম, “আমি এখন আর কিছুই খেতে পারবো না, তুই একটা খেয়ে আরেকটা রেখে দে। সকালে কাপড় নিয়ে মহল্লায় যাবার আগে খেয়ে যাস।”
কানাই বলল, “তুই খাবি না কেন? খেতে হবে! আয় শিগগির। তুই না খেলে আমিও খাব না।”
বললাম, “কী আর খাব রে কানাই, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। না বুঝে, আর না শুনে হুটহাট করে তোর সাথে চলে এলাম! এখন তো দেখছি কাজের কাজ কিছুই হলো না। আমি তোর সাথে ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি। জানি না দেশে ওরা কী খাচ্ছে! কী করছে! কেমন আছে! ওদের কথা আমার বার-বার মনে পড়ছে! এখন যে কী করি! ভেবেই পাচ্ছি না। তুই আমাকে যে ভাবেই পারিস, আমার দিদির বাড়িতে পৌঁছে দে। দেখি সেখানে গিয়ে কিছু করা যায় কিনা!”
আমার কথা শুনে কানাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমি এক গ্লাস জল ঢালছি পান করার জন্য। তা কানাই চেয়ে-চেয়ে দেখছে, কিচুই বলছে না। আমি জল পান করে খাটে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় কানাই আমার হাত চেপে ধরে বলল, “দেখ তোকে নিয়ে আমিও খুব চিন্তায় আছি। রতন চক্রবর্তীর কথা শুনে কেন-ই-বা তোকে আমার সাথে আনলাম, সেই চিন্তাই করছি। তুই সাংসারিক মানুষ! এভাবে তোকে আমার সাথে এখানে আনা ঠিক হয়নি। এখন তোকে তোর দিদির বাড়ি পাঠালে, যদি তোর দিদি তোকে চিনতে না পারে? যদি তোর দিদিকে তুই চিনতে না পারিস? তা হলে তো অবস্থা আরও খারাপ হবে। এখন তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি তা-ই হবে। এখানে আমি থাকি ভাড়া। বর্তমানে সাথে এখন উপযুক্ত দুই বোন। তোকে এখন আমার সাথে রাখতেও পারছি না, আবার তাড়িয়ে দিতে পারছি না। এখন তুই বল আমি কী করবো।”
কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, “আমার সাথে ৫০০ টাকার মতো অবশিষ্ট আছে। এই টাকা থাকতে থাকতে তুই আমাকে আমার দিদির বাড়ি পৌঁছে দে। দিদি, জামাইবাবু ও ভাগিনাদের সাথে বুঝে দেখি কিছু করা যায় কি-না! আমার বিশ্বাস, দিদি আমাকে ফেলে দিবে না! আর ভাগিনারাও আমাকে নিয়ে বিরক্ত হবে না। যদিও জীবনে কোনও দিন দিদির বাড়ি যাইনি, তাতে কী হয়েছে? আমাকে ওরা ফেলবে না।”
আমার কথা শুনে কানাই বলল, “আচ্ছা তা-ই হবে। আগামী পরশুদিন আমি তোকে জলপাইগুড়ির বাসে উঠিয়ে দিচ্ছি। তুই তোর বড়দি'র বাড়ি গিয়ে দেখ কিছু করতে পারিস কিনা।”
বললাম, “ঠিক আছে তা-ই কর। দিদির বাড়ি পৌঁছে আমি তোকে চিঠি দিয়ে জানাবো।”
কানাই বলল, “ঠিক আছে তা-ই হবে। এখন আয়, একটা রুটি খেয়ে নে।”
কানাইর কথামত একটা পাউরুটি খেলাম। কানাইও খেল।
খাওয়া শেষে কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোর কাছে আছে, এই টাকা থেকে একটা টাকাও খরচ করবি না। দুই চার পয়সা যা লাগে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিবি, আমি দিবো। জলপাইগুড়ি যাওয়ার পর হঠাৎ করে কার কাছে টাকা চাইবি। ভারতের বাড়ি। নিজের কাছে না থাকলে কেউ দিবে না।”
বললাম, “সেই বুঝ আমার বোঝা হয়ে গেছে ফুলিয়া গৌরাঙ্গ দাদার বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই। এখন আমি খুবই হুশিয়ার! অন্তত ভারতে যতদিন থাকবো, ততদিন।”
আমার কথা শুনে কানাই বলল, “হ্যাঁ তা হলেই এই দেশে কিছু করতে পারবি। এখানে থাকলে, এখানকার মনুষের মতোই চলতে হবে, বুঝলি?”
এরপর কথা বলতে বলতে একসময় দুজনে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল যে কখন হয়েছে তা আর আমাদের জানা নেই। কানাইর মেজো বোন দরজার কাড়া নাড়ছে, আর দাদা দাদা বলে ডাকছে। ওঠলাম ঘুম থেকে। কানাইও ওঠল।
তখন সকাল ১০ টা। কানাইর ছোট বোন বলল, “আজ কি তুমি মহল্লায় যাবে না দাদা?”
কানাই বলল, “তুই এখন যা, আমি হাতমুখ ধুয়ে রেডি হচ্ছি। মহল্লায় না গেলে আমার একটু সমস্যা হবে।”
আমি বললাম, “পকেটে টাকা না থাকলে-তো সমস্যা হবেই। তুই আলসেমি না করে তাড়াতাড়ি করে মহল্লায় বেরিয়ে পড়।”
কানাই'র বোন ডলি বলল, “দাদা, কাকীমা রুটি বানিয়েছে। তোমাদের দুইজনের জন্য চারটে রুটি নিয়ে আসি?”
কানাই বলল, “না থাক, দরকার নেই। আমরা সামনের হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিবো, তুই যা।”
কানাই'র বলেন চলে গেল। কানাই তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে আসলো। আমি ওর আগেই হাতমুখ ধুয়ে বসে আছি। বিক্রি করার মতো কাপড়গুলো নেওয়ার জন্য ভ্যানগাড়ি আগেই রেডি থাকে। মহল্লায় যাবার আগে ভ্যানগাড়ির ড্রাইভারকে আর খুঁজতে হয় না। কাপড়গুলো ধরাধরি করে ভ্যানগাড়িতে নিয়ে ওঠালাম। কানাই মহল্লায় চলে গেল।
আমি আজও সেদিনের মতো একা হয়ে গেলাম। একা একাই বাঘা যতীন এলাকাটা একটু ঘোরা-ঘুরি করলাম। দুপুরের আগেই বাসায় গেলাম, স্নান করার জন্য। এ ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার। উদ্দেশ্য হলো, এখানে আসার পর বাড়িওয়ালার ঘরে কোনও দিন দুপুরে খাওয়া হয়নি, তাই। খেয়েছি হয়ত দু’একদিন সকালে।
স্নান করার জন্য কানাই'র বোনের কাছ থেকে সাবান চেয়ে নিয়ে গেলাম লেকে। স্নান করে এলাম বাসায়। কানাইর দু’বোন আগেই বাড়িওয়ালীকে বলে রেখেছে যে, নিতাই'দা আজ দুপুরবেলা ভাত খাবে। স্নান করে বাসায় গিয়েই দেখি কানাই'র দু'বোন বসে আছে আমার অপেক্ষায়।
জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে, তোরা এখানে বসে আছিস কেন?”
বলল, “দাদা, এখানে এসেছ পর্যন্ত একটা দুপুরেও আমাদের সাথে বসে খাওনি। আজ আমরা আগেই বাড়িওয়ালী কাকীকে বলে রেখেছি নিতাই'দা দুপুরে খাবে। এখন আমাদের সাথে আস, সবাই একসাথে বসে খাবো।”
ওদের কথা শুনে মনে মনে হাসলাম! রক্তের সম্পর্ক নেই! তবুও এতো মায়া। বসে আছে একসাথে খাবে বলে। ওদের বললাম, “তোরা যা আমি জামাকাপড় পরে এক্ষুণি আসছি।”
ওরা দু'বোন চলে গেল বাড়িওয়ালার দোতালায়। আমি জামাকাপড় পরে বাড়িওয়ালার ঘরে গেলাম খেতে। কানাই'র দুই বোন আর বাড়িওয়ালার মেয়েটা ভাতের থাল সামনে রেখে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। আমাকে দেখেই ওরা বলছে, “এইতো দাদা এসে গেছে। বসেন দাদা বসেন।”
বসলাম ওদের একপাশে ঠিক চোরের মতন চুপ করে। ভাত মেখে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাড়িওয়ালী কাকী আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা তুমি তোমার বোনের বাড়ি কবে যাচ্ছ?”
আমি থতমত হয়ে বললাম, “কাকীমা কানাইর সাথে কথা হয়েছে দু'এক দিনের মধ্যেই যাবো।' কাকীমা বললো, “দেখ সেখানে গিয়ে কিছু করতে পার কিনা।”
বললাম, “হ্যাঁ কাকীমা, দেখি সেখানে যাওয়ার পর সবকিছু বুঝা যাবে।”
লজ্জায় লজ্জায় কোনওরকমে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘর থেকে বের হলাম।
বাড়িওয়ালির কথা শুনে আমার বেশি ভালো লাগেনি। কেননা, এই ক’দিনে ভারতের হিসাব-কিতাব আমার জানা হয়ে গেছে, তাই। তারা পারে না, জোর করেই একটা অতিথিকে তাড়িয়ে দেয়! যদি সম্ভব হতো, তা হলে তা-ই করতো।
এসব ভাবতে ভাবতে নিজের কাছে নিজেকেই খুব ছোট মনে হচ্ছিলো! কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। পারলে তখনই বাঘা যতীন ত্যাগ করতাম। কিন্তু না, তা আর হচ্ছিলো না। মন খারাপ করেই কানাইর বাসায় এসে শুয়ে রইলাম।
একসময় বিকাল হয়ে গেলো। কানাই মহল্লা থেকে বাসায় আসলো। কিন্তু কানাই যে কখন এলো, তা আর আমি টের পাইনি। ও মহল্লা থেকে এসে হাতমুখ দুয়ে আমাকে ঘুম থেকে জাগালো।
জিজ্ঞেস করল, “কিছু খেয়েছি কিনা!”
আমি বললাম, “খেয়েছি।”
তখন সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাতের পালা। কানাই বলল, “চল ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি শুনি?”
কানাই বলল, ”ধর্মতলা যাবো জলপাইগুড়ির একটা টিকেটের জন্য।”
তখন বুঝলাম আগামীকালই আমি বাঘা যতীন ত্যাগ করছি।
চলবে...
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com