সেবক ব্রিজ— পাহাড়, নদী ও অদেখা সিকিম


শিলিগুড়ি থেকে বীরপাড়া যাবার পথে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্য চোখে পড়ে, তার অন্যতম নিদর্শন হল সেবক রোড এবং তার বুকে গড়া সেবক ব্রিজ। এই জায়গাটি শুধু একটি যাতায়াতের মোড় নয়, বরং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও হিমালয়ের পাদদেশীয় এলাকার এক গভীর সংযোগস্থল।

সেবক রোড শুরু হয় শিলিগুড়ির ব্যস্ত শহরাঞ্চল থেকে, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নগরের কোলাহল পেছনে ফেলে মানুষ প্রবেশ করে প্রকৃতির শান্ত নিসর্গে। এই পথের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ স্থান হলো সেবক ব্রিজ। এটি তিস্তা নদীর উপর নির্মিত এক চমৎকার সেতু, যা শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়, প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকেও এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।

সেতুটির এক পাশে রয়েছে সিকিমে যাবার পথ, যা পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। আর মাঝ বরাবর, সেবক ব্রিজের এক কোণ ঘেঁষে চোখে পড়ে এক অনুচ্চ পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক কালীমন্দির। মন্দিরটির অবস্থান এমন যে, মনে হয় যেন মা কালীর কৃপাদৃষ্টি সারা সেবক রোড ও ব্রিজজুড়ে বিস্তৃত। ভক্তরা প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে মন্দিরে পুজো দিয়ে যান, সেখান থেকে চারপাশের প্রকৃতি উপভোগ করেন।

পাহাড়, নদী ও মন্দির—এই ত্র্যয়ী মিলনে সেবক জায়গাটি যেন এক তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। সেবক ব্রিজ অতিক্রম করলেই শুরু হয় ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অরণ্যপথ। এই পথ ধরে গাড়ি চলে যায় বীরপাড়া হয়ে আসাম-মিজোরাম অভিমুখে। একদিকে যেমন রেলপথ চলে গেছে সমান্তরালভাবে, তেমনি অন্যদিকে পাহাড় বেয়ে উঠে যাওয়া সরু পথ চলে গেছে উত্তর-পূর্ব ভারত ও সিকিমের দিকে। এই পথ দিয়ে যেমন পর্যটক যায়, তেমনি সেনাবাহিনী ও পণ্যবাহী ট্রাকও চলাচল করে নিরবচ্ছিন্নভাবে।

এই এলাকাটি একদিকে যেমন ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্যও অনস্বীকার্য। উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সংযোগস্থল হিসেবে সেবক রোড ও সেবক ব্রিজ শুধু পথ নয়, এক ইতিহাস, এক যাত্রার প্রতীক

সেবককে কেন্দ্র করে যেভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যটন, এবং সাংস্কৃতিক চর্চা গড়ে উঠেছে, তা এক অসাধারণ সাফল্যের গল্প। এই ব্রিজ শুধু দুটি প্রান্ত নয়, দুই ভুবন—সমতল ও পাহাড়, মহাসড়ক ও প্রকৃতি, ধর্ম ও দৈনন্দিনতা—এদেরও যুক্ত করেছে এক সূক্ষ্ম সেতুবন্ধনে।

এরকম নান্দনিক প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তখন, যখন আমি কোলকাতা থেকে আমার বড়দি'র বাড়ি জলপাইগুড়ি জেলার ভুটান ঘেঁষা বীর পাড়া যাচ্ছিলাম। সময়টা ছিলো, ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে। কোলকাতা থেকে আমার বড়দি'র বাড়ি যাত্রাপথে এরূপ মনোরম পাহাড় ঘেঁষা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে নিজের দু-চোখের ক্যামেরা দিয়ে ছবি মনের মেমোরিতে সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম, সময় পেলে আবার এখানে এসে এই সেবক ব্রিজের আশে-পাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য।

তারপর বীর পাড়া রবীন্দ্র নগর কলোনি বড়দি'র বাড়িতে গিয়ে বীর পাড়ার আশে-পাশের প্রায়-সকল জায়গা-সহ ভারত সীমান্তবর্তী ভুটানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জায়গায় ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু সময় আর সুযোগ না মেলাতে শিলিগুড়ির সন্নিকটে সেবক ব্রিজ দেখার ইচ্ছেটা আর পূরণ করতে পারছিলাম না।

একসময় দোলপূর্ণিমার (হোলি) আগমন ঘটলো। হোলির রঙে রঙিন হচ্ছিল পুরো বীর পাড়া-সহ ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা। আর আমি ছুটে চললাম, সেবক ব্রিজের আশে-পাশে থাকা পাহাড়ের পাদদেশে। একসময় পৌঁছে গেলাম সৌন্দর্য ঘেরা শিলিগুড়ি টু-সিকিম যাবার মাঝপথে সেবক ব্রিজ।

সেবক ব্রিজ পাড় হওয়ার পরই বাস থামলো পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সেবক কালী মন্দিরের নিচে। আমি বাস থেকে নেমেই যেই পাহাড়ের চূড়ায় কালীমন্দিরটি অবস্থিত সেই পাহাড় ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে পৌঁছে গেলাম সেবক কালী মন্দিরে

আহা, কী সুন্দর দৃশ্য! এ যেন মহান সৃষ্টিকর্তার নিজ হাতে গড়া সৌন্দর্য্য লীলা। চারিদিকে পাহাড়, পাহাড়ের তলদেশে আঁকা-বাঁকা সিকিম অভিমুখী মহাসড়ক। আবার কালী মন্দিরের চূড়া থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখা যায়—তিস্তা নদী যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে পাহাড়ের ফাঁক গলে, আর সেই নদীর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস-ঘেরা সেবক ব্রিজ

মনে হচ্ছিল, আমি সময়ের সীমানা পেরিয়ে কোনো পরাবাস্তব দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে আছি। হাওয়ার ঝাপটায় চোখ বুজে অনুভব করলাম, আমার দীর্ঘদিনের না-পাওয়া ইচ্ছেটা আজ পূর্ণ হলো। আর তখনই মনে হলো, জীবনে সব ইচ্ছা পূরণ হয় না ঠিকই, তবে যেটা হয়, তা যেন বহুদিনের গর্ভে পুষে রাখা এক স্বপ্নের বাস্তব রূপ!

অনেকক্ষণ ঘুরে-ফিরে সেবক ব্রিজের আশেপাশে বেশ কিছু দেখলাম ঠিকই, কিন্তু সিকিম যাবার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সিকিম যাবার রাস্তার ধারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি—যেখানে পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে এক সরু, আঁকাবাঁকা পথ। বাস আর গাড়িগুলো একে একে উধাও হয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ের বাঁকে। মনে হচ্ছিল তারা যেন স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সেই মোহময় রাস্তার ধারে—দৃষ্টিতে আকাঙ্ক্ষা, মনে কেবল একটিই প্রশ্ন:

"আমি কি সিকিম যেতে পারতাম?"

শেষপর্যন্ত সাহস আর সঞ্চয় হলো না। না, যেতেও পারিনি। তবে সেই না-পারাটাও থেকে গেল একটা গল্প হয়ে—যা হয়তো কোনোদিন ঠিক এইভাবে লিখে যাবো, যেমন আজ লিখছি। অপূর্ণতা নিয়েই তো হয়তো জীবনের আসল সৌন্দর্য।


— নিতাই বাবু
গোদনাইল, নারায়ণগঞ্জ
সহযোগিতায়: চ্যাটজিপিটি ওপেন এআই

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা