গ্রাম ছেড়ে কেন আসলাম কংক্রিটের শহরে


গ্রাম ছেড়ে কেন আসলাম কংক্রিটের শহরে

নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে এক ছোট্ট গ্রাম— মাহাতাবপুর। সেখানেই আমার জন্ম, ১৯৬৩ সালের ৮ই জুন, এক হিন্দু পরিবারে। চোখে না দেখলেও, আমার ঠাকুরদা-পিতামহদের সময়কাল যে অনেক ভালো ছিল, সে ইঙ্গিত মেলে আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া বাড়ি দেখলেই।

পুরো গ্রামে তখন শুধু আমাদেরই দালান ঘর ছিল— চট্টগ্রাম থেকে আনা পাহাড়ি লালচে মাটি দিয়ে তৈরি সেই ঘরগুলো দেখতে ছিল অনেকটা গুদামঘরের মতো। গ্রামের মানুষের মুখে তাই আমাদের বাড়ির নাম ছিল “মাইডগা গুদামওয়ালা বাড়ি”। আমার দাদার নাম ছিল পঞ্চনন্দ পাল, বাবার নাম শচিন্দ্র চন্দ্র পাল।

আমরা ছিলাম চার বোন, দুই ভাই। আমি নিতাই চন্দ্র পাল— সবার ছোট। শুনেছি, আমার ঠাকুরদা চট্টগ্রাম থেকে পণ্য কিনে এনে চৌমুহনী বাজারে বিক্রি করতেন। দোকান, গোডাউন ছিল তার। মাসে বেশ ক'দিন তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন, আর সেখান থেকেই এনে দিয়েছিলেন আমাদের সেই বিখ্যাত ঘরের মাটি ও কারিগর।

আমাদের পরিবারের দালান ঘরগুলো ছিল মাটি দিয়ে তৈরি হলেও বেশ মজবুত— দেয়াল ছিল প্রায় দুই হাত পুরু। ঘরগুলোর ভিতরে আলাদা আলাদা কক্ষ, উঠোন থেকে অনেক উঁচু, যেন বর্ষায় বন্যায়ও ভিজে না যায়। তখন সিমেন্ট-রডের অভাব ছিল চরম। দেশীয় ইট আর পেক মাটি দিয়েই মানুষ দালান তুলতো।

কিন্তু স্বচ্ছলতার সেই আলোর নিচেই ছিল আমাদের সংসারের দীর্ঘ ছায়া। বড় জেঠা-কাকারা যেখানে স্বাবলম্বী, সেখানে আমরা ছিলাম অভাবগ্রস্ত। বাবা ও বড়দার চাকরির বেতনের উপরই চলত আমাদের সংসার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সেই দুর্দশাকে আরও প্রকট করে তোলে।

বাবা ও দাদা যখন টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন, আমরা তখন দিন পার করতাম আধা-পেটে কিংবা না খেয়ে। সকালের খাবার রাতে খেতাম, আর রাতের খাবার জুটত না। ধানকুড়ানি করে জুটত কিছু চাল, পূজার সময় সেটাই চিড়া-মুড়ির জোগান দিতো। আর সুপারি কুড়িয়ে বা কচুর লতি বিক্রি করে মেলায় যেতাম, মা হাতে গুঁজে দিতেন এক-দু’পয়সা।

যুদ্ধ চলাকালীন বাবা বাড়ি ফিরে এলেন খালি হাতে। মা তখন তাঁর শেষ গয়না, একজোড়া কানের দুল বন্ধক রেখে কিছু টাকা জোগাড় করলেন। সেই টাকায় বাবা মুড়ির ব্যবসা শুরু করলেন। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করলাম।

এরপর আমাদের পরিবারে প্রথম আলো এনে দিল আমার মেজো বোনের বিয়ে— সেটাও নারায়ণগঞ্জে। জামাই ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের শ্রমিক, কোনো যৌতুক না চেয়ে শুধু বিয়েটা হোক, এই চাওয়া ছিল তার।

আমি মায়ের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে গেলাম, বিয়ের আয়োজনে। বিয়ে শেষে জামাইবাবু ও বোনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ফিরে এলাম। কিন্তু তখন সারা দেশে বাড়ছে চোর-ডাকাতের উপদ্রব। আমাদের বাড়িতে ডাকাতদের হানা ছিল বারবার, কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের বাড়ি ছিল মুক্তিবাহিনীর আড্ডাস্থল। প্রতিবেশীরা ভাবতো, ওটাই বুঝি আসল ক্যাম্প!

অতিষ্ঠ হয়ে একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম— আর নয়, গ্রামে থাকা সম্ভব নয়। ১৯৭২ সালের শেষদিকে আমরা পুরো পরিবার নিয়ে চলে এলাম নারায়ণগঞ্জ শহরে— বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রামের পাশে আদর্শ কটন মিলের শ্রমিক কোয়ার্টারে। কংক্রিটের শহর তখনো গড়ে ওঠেনি পুরোমাত্রায়, কিন্তু গ্রাম থেকে শহরের দিকে ছুটে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেদিনই নিয়েছিলাম।

সেই সময়টা ছিল নতুন শুরুর। অস্থিরতার ভেতরেও কিছু আশা, কিছু নির্ভরতার আলো। সেই ভাঙাগড়ার কাহিনি আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে।

— নিতাই বাবু
পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক
ব্লগ.বিডিনিউজ২৪.কম

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা