নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নং ওয়ার্ড: গোদনাইল ও এক জ্যান্ত পাটশিল্প
নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নং ওয়ার্ড: গোদনাইল ও এক জ্যান্ত পাটশিল্প
এই এলাকাটি নারায়ণগঞ্জ সিটি থেকে ৪.৪ কিমি: উত্তরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন। বর্তমানে এই গোদনাইলে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসবের মধ্যে রয়েছে রপ্তানিমুখী নীট গার্মেন্ট, ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, রি-রোলিং মিলস্। কোন একসময়ের এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত চার-পাঁচটি টেক্সটাইল মিলস্ও ছিল এখানে। সাথে আছে বহু পাট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, এই পাট নারায়ণগঞ্জকে এনে দিয়েছিল প্রাচ্যের ডান্ডি উপাধি। আগে নারায়ণগঞ্জে যেখানেসেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যেত বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন, দেখা যেত পাটকে বেলিং করার মতো জুটপ্রেস। সারা বাংলাদেশে চট্টগ্রামের পর নারায়ণগঞ্জ ছিল দেশের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক শহর।
এখনো এই নারায়ণগঞ্জে সূতা ও রং-এর জন্য সারাদেশে সুখ্যাতি বহাল আছে। বাংলাদেশের যেখানেই টেক্সটাইল মিল আর ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ থাকুক-না-কেন, সূতা রং নারায়ণগঞ্জ থেকেই নিতে হবে, এছাড়া আর উপায় নাই। যদিও কালের বিবর্তনের ফলে বস্ত্রশিল্পের বিলুপ্তি ঘটেছে, রয়ে গেছে কিছু সংখ্যক পাট বেলিং জুটপ্রেস। এমন একটি জুটপ্রেসের সাথে আমার সম্পৃক্ততা অনেক বছর থেকে, যা এখনো আছে। আজ এই জুটপ্রেসের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিবো, তার আগে পাট সম্পর্কে শর্টকাট কিছু আলোচনা করে নেই।
বাংলার সোনালী আঁশের কথা সেই ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। বাংলার সোনালী আঁশ আমাদের গর্ব, পাটের জন্য আমরা গর্বিত। আমার মতো ছোট-বড় ছেলে-বুড়ো সবাই জানে বাংলার সোনালী আঁশের কথা। প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক থেকেই সোনালী আঁশের শিক্ষা শুরু হয়, বাংলার গৌরব গাঁথা এই সোনালী আঁশের ইতিহাস। তার নাম পাট, পাট একটি বর্ষাকালীন ফসল, পাটই বাংলার শত বর্ষের ঐতিহ্য।
বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়; পাট মূলতঃ দুই ধরনের জন্মায়- (১) corchorus capsularis (সাধা পাট) এবং (২) corchorus olitarius (তোষা পাট ); এটি Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। পাটকে আরো একাধিক নামে ডাকতে শোনা যায়, যেমন- দেশী পাট, কেনাফ পাট, মোস্তা পাট ও বগি পাট। আর ইংরেজি নামতো সবারই জানা (jute) জুট। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা কীভাবে এই বাংলার খ্যাতনামা পাটকে বেলিং করে বাজারজাতকরণ করা হয়।
তাহলে জেনে নেই, কীভাবে এই পাট বেলিং করে পাট শ্রমিকেরা।
পাট একটি বর্ষজীবী ফসল। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত। চৈত্র-বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণ। পাট একটি লাভজনক ফসল, যা অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহকারী একটি কৃষিজাত ফসল। এই পাট শুধু আমাদের দেশেই বেশি জন্মায়, এবং দেশের সব জেলায়, সবখানে। এই পাটের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক ও কৃষক-কৃষাণীর আত্মা ও জীবিকা। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কৃষকেরা জমি থেকে পাটগাছ কেটে আঁটি বেঁধে পানিতে জাঁক দিয়ে ডুবিয়ে রাখে। ১০ থেকে ১২ দিন পর পানি থেকে খুব যত্ন সহকারে ডোবানো পাটগাছের আঁটিগুলো উঠিয়ে আনে। ১০/১২ দিনে পানিতে ডুবিয়ে রাখার ফলে আঁটি বাঁধা পাট পঁচে যায়। আসলে কিন্তু পাটগাছের পাট পঁচে যায়নি, দীর্ঘদিন পানির নীচে থাকার কারণে গাছ থেকে পাট নরম হয়ে যায়। নরম হওয়ার কারণেই খুব সহজে গাছ থেকে পাট বা আঁশকে আলাদা করা যায়। (পাটগাছ থেকে পাটের আঁশ আলাদা করার পর সেই গাছ হয়ে যায় পাটখড়ি। এই পাটখড়ি দিয়েও অনেক কাজ হয়, পাটখড়ি জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়, আবার ঘরের বেড়া তৈরির কাজে লাগে।
পাটখড়ি দিয়ে এখনকার দিনে অনেক নামীদামী বোর্ড তৈরি হয়, যেসব বোর্ড দিয়ে ফ্যামিলি ফার্নিচারের আসবাবপত্র তৈরি হয়)। এভাবেই কৃষকরা পাটগাছ থেকে এই মূল্যবান পাট সংগ্রহ করে শুকিয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে। কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেয় দেশের বড় বড় পাট ব্যবসায়ীরা। সেই পাট কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে, কিংবা ব্যবসায়ীদের নিজস্ব মিলে বা গোডাউনে জমা রাখে বিদেশে রপ্তানী করার জন্য। বিদেশে রপ্তানীর আগে এই পাটকে যাচাই-বাচাই করে বেল আকারে তৈরি করার জন্য দরকার হয় জুটপ্রেসের। এমনই কয়েকটি জুট প্রেস আমাদের নারায়ণগঞ্জে আছে।
এমন একটি জুট প্রেস আছে নারায়ণগঞ্জ সিটির ১০ নং ওয়ার্ড গোদনাইলে। যার নাম- বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ)। এই সংস্থাটি পাটের জন্যই খ্যাত। এই সংস্থাটি বহু প্রাচীন। এই সংস্থার অভ্যন্তরে আছে পাট রাখার বিশাল বিশাল গোডাউন, আছে পাট বেল করার জন্য সেই প্রাচীন আমলের প্রেস মেশিন। পাটের ভরা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপ-জেলা থেকে এখানে পাট আসে নৌপথে ও স্থলপথে। নৌকা ও ট্রাক থেকে এই পাটকে নামানো হয় নারী-পুরুষ শ্রমিক দ্বারা। তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় দৈনিক মুজরী হিসেবে।
পাট বেলিং করার প্রথম ধাপে যারা কাজ করে, সেই কাজের নাম আমদানী কাজ, যারা এই কাজ করে তাঁদের বলে ‘আমদানি’ শ্রমিক। নৌকা বা ট্রাক থেকে আমদানি শ্রমিকেরা পাট নামিয়ে নিয়ে যায় গোডাউনে, সেখান থেকে শুরু হয় পাটের ওজন সহ যাচাই বাছাই-এর কাজ। গোডাউনে পাটকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়, করা হয় পাটে গোড়া ছাটাই, তারপর ৫০ কেজি করে পাটের বোজা বাঁধে সারি সারি করে গোডাউনে রাখা হয়।
এই পাট যেদিন বেলিং হওয়ার জন্য প্রেসে যাবে সেদিন প্রেসে কাজ করা বোজা শ্রমিকরা ওই পাট মাথায় করে নিয়ে যায় প্রেসে। প্রেসে যেসব শ্রমিক কাজ করে কাজের আবার ভিন্ন ভিন্ন নামের সাথে থাকে ভিন্ন ভিন্ন কাজ। যেমন; বোজা শ্রমিক, কয়েলি, খালাসি, শিক গাঁথা, কাঁচা-পাকা ও রপ্তানি শ্রমিক। বোজা শ্রমিক পাটের বোজা নিয়ে যাবে প্রেসের উপরে, সেখানে কয়েলি (যিনি পাট ওজন করে ) ১৮৫ কেজি পাট মেপে-মেপে আলাদা-আলাদা করে রাখে।
সেখান থেকে খালাসি শ্রমিক মাপা পাট টেনে নিয়ে ফেলে প্রেসের বোঙ্গায় (বিশাল গর্ত, গর্তের নীচে থাকে হাউস, হাউসে থাকে মবিল তৈল)। তখন প্রেস ড্রাইভার (যিনি প্রেস চালায়) গিয়ার চেপে দিলে নীচ থেকে আস্তে আস্তে মবিল তৈলের প্রেশারে ১৮৫ কেজি পাটকে একটা বেল আকারে তৈরি করে ফেলে। এই বেলটাকে বলে কাঁচা বেল। তারপর বেলটা যায় পাকা কিরার জায়গায়, সেখানেই বেলটাকে আরো একটু বেশি টাইট করে রশি দিয়ে পেঁচানো হয়। যিনি রশি তৈরি করে দিচ্ছে তাকে বলে শিকগাঁথা শ্রমিক, যারা বেলটা বানাচ্ছে তাদের বলে খালাসি শ্রমিক।
খালাসি শ্রমিক বেল তৈরি সম্পূর্ণ করে ধাক্কা দিয়ে প্রেসের নীচে ফেলে দেয় বোঙ্গায়, তৈরিকৃত বেলটা বোঙ্গা দিয়ে নেমে আসে নীচে রপ্তানি শ্রমিকেদের কাছে। রপ্তানি শ্রমিক সেই তৈরিকৃত বেলটাকে প্রথমে গোডাউনে, হয়-তো-বা সরাসরি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ট্রাকে না-হয় নৌকায় নিয়ে উঠিয়ে দেয়। এভাবে পাটের বেল চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলার জুটমিলে বা দেশের বাইরে কোনো অজানা গন্তব্যে, দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা।
✍️ লেখক পরিচিতি
নিতাই বাবু — একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক— ব্লগ ডট বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম। তিনি লিখেন নারায়ণগঞ্জের নদী ও শিল্পনগর ইতিহাসের একজন জীবন্ত দলিলকার। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্লগার হিসেবে তিনি লেখেন প্রান্তিক জনপদের শ্রমজীবী মানুষ ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প নিয়ে। নারায়নগঞ্জের কথা উঠলেই তার লেখার গন্ধ পাওয়া যায়।
🔗 শেয়ার করুন
📘 ফেসবুকে শেয়ার করুন
🐦 টুইটারে শেয়ার করুন
💬 হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান
📅 প্রকাশকাল: জুলাই ২০২৫
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com