অবহেলিত প্রাণী কুকুরের ভালবাসা
অবহেলিত প্রাণী কুকুর
কুকুর প্রাণিগুলো পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের কাছে অবহেলিত। এদের মধ্যে নামমাত্র কিছু উঁচু গোত্রের অল্পসংখ্যক প্রাণী থাকে আদরে। আর সবই থাকে অনাদরে আর অবহেলায়। এই প্রাণীটির নাম কুকুর। আমরা অনেকেই সোজা কথায় কুত্তা বলে ডাকি। এদের ইংরেজিতে কি যেন বলে? তা লিখে আমি সবাইকে ছোট করতে চাই না। কারণ, এগুলোর ইংরেজি শব্দ লিখবার শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার নেই। শুধু জানি, এগুলো কুকুর, কথা বলতে পারে না। কথা না বলতে পারলেও, এরা মানুষের চোখ এবং হাতের ইশারা সবই বুঝে। বুঝে না শুধু বেঈমানি। থাকে না কোনো মিথ্যা প্রচারণায়। এদের মতন আরও অনেক-অনেক প্রাণীই আছে, ওরাও আমাদের কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য।
এদের নিয়ে আমি কোনও গবেষণা করছি না। আর এদের নিয়ে গবেষণা পর্যালোচনা করার মতো ডিগ্রিও আমার নেই। গবেষণা করার অভিজ্ঞতা ছাড়া, কুকুর-বিড়াল নিয়ে কোনো গবেষণা করা যায় না। যদিও করি, তা হলে সাহায্য নিতে হবে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগল অথবা উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়ার। এসব সাইটের তথ্য নিয়ে কিছু লিখলে আবার সেই লেখা ব্লগে প্রকাশ হবে না। কেননা, এসব তথ্যানুসন্ধান সাইটগুলোর লিংক সংযোজন আমি করতে পারি না, তাই। তাই শুধু এদের নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাত্র।
এরা গৃহপালিত প্রাণী গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ভেড়ার মতন গৃহপালিত পশু নয়। তবু অনেক গৃহস্থ শখ করে এদের আদর করে বাড়িতে রাখে। শুনেছি কুকুর নাকি সবসময় গৃহস্থের মঙ্গলকামনাই করে থাকে। এ বিষয়ে আমার মা বলতেন, “কুকুর সবসময় কামনা করে গৃহস্থের উন্নতি হোক, আমি কুকুর তিনবেলা ভাতের মাড় (ফেন) পাবো।” মা আরও বলতেন, “কুকুর-বিড়াল হলো বাড়ি-ঘরের লক্ষ্মী। এসব প্রাণী বাড়িতে না থাকলে, বাড়ির শোভাই থাকে না।”
আমি ছোটবেলায় দেখেছি, মা শখ করে একটা বিড়াল পোষতেন। বিড়ালটি ছিল সাদা রঙের। আমার বড়দিদিরা বিড়ালটিকে সবসময় জামা পরিয়ে রাখতেন। গলায় পড়িয়ে দিতেন লাল মুতির মালা। বিড়ালটি আমার মা এনেছিলেন এক ঠাকুরবাড়ি থেকে। মা আদর করে সেই বিড়ালটির নামও রেখেছিলেন “মনি”। বিড়ালটি এতই পোষ মানিয়েছিল যে, আমার মায়ের প্রায় সব কথাই ও বুঝত। “মনি” বলে ডাক দিতে দেরি, ওর আর কাছে আসতে দেরি হতো না। রান্নাঘরের সবকিছু খোলা থাকলেও, ভুলেও বিড়ালটি কিছু ছুঁয়ে দেখত না।
শীতের রাতে আমাদের পোষা বিড়ালটি আমাদের সঙ্গে ঘুমাত। অনেক সময় বিড়ালটির নাকের ডাকের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। সে যে কি শব্দ! ঘুরর ঘুরর, যেন এক হাঁপানির রুগীর নাকের ডাক।
আমার মা আমাদের বাড়িতে কুকুরও পোষতেন। তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেশি ছিল, তাই। কুকুরের ডিউটিই ছিল, দিনে-রাতে বাড়ি পাহারা দেওয়া। রাতেরবেলা গাছের একটা শুকনো পাতা ঝরে পড়লেও, ঘেউঘেউ করে উঠত। আজও চোখে ভাসে আমার মায়ের সেই কুকুর-বিড়াল পোষার দৃশ্যগুলো।
বর্তমানে আমার কোনো বাড়িঘর নেই। থাকি পরের বাড়িতে ভাড়া, যাকে বলে ভাড়াটিয়া। “ভাড়াটিয়া” কথাটি ইংরেজিতে কি যেন বলে? তা গুগল ট্রান্সলেটে দেখলে একটা শব্দ পাওয়া যায়। কী পাওয়া যায়? তা আর আমি লিখলাম না।
পরের বাড়িতে ভাড়া থাকলেও, আমার নজর শুধু কুকুর-বিড়ালের দিকেই বেশি। একটা বিড়ালছানা দেখলেই, ওকে কোলে-কাঁখে নিতে মন চায়। সুযোগ পেলে নিইও অনেক সময়। তার জন্য ঘরের গিন্নির বকুনিও খেতে হয়। কারণ, আমরা হিন্দুরা আচার জানি না, অথচ বিচার জানি বেশি।
আমি বর্তমানে থাকি, নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নম্বর ওয়ার্ডের একটা মহল্লায়। যেই বাড়িতে থাকি সেটা অনেক বড়বাড়ি, বাড়িতে ১৪টি ভাড়াটিয়া। বাড়ির ভেতরে দু’পাশে লম্বালম্বি করে তৈরি করা ভাড়াটিয়াদের ঘর। মাঝখানে উঠোন। খোলা-মেলা ও সুন্দর পরিবেশ।
অফিসের সামনেই একটা মহল্লা, নাম গোদনাইল রসূলবাগ। হঠাৎ এই মহল্লায় কেউ গেলে বুঝে নেবে—এখানে মনে হয় বাড়ি-বাড়িই কুকুর পোষে। প্রতিবছরই ভাদ্র-আশ্বিন আর কার্তিক মাসে কুকুর বাচ্চা প্রসব করে। তখন পুরো মহল্লা ভরে থাকে ছোট ছোট কুকুরের বাচ্চায়।
এসব দেখে আমারও শখ হয় বাচ্চাগুলোকে কোলে নিতে। কিন্তু পারি না লোকলজ্জায়। তবুও থেমে থাকার পাত্র আমি নই। একদিন একটা সাদা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে গেলাম বাসায়। বাসায় নেওয়ার সাথে সাথেই ঘটে গেল হট্টগোল। কারণ? আমরা হিন্দু বলে কথা!
তবুও আমি থামছি না। শুরু করলাম বাচ্চাটির যত্নআত্তি। রাখার জায়গা ঠিক করলাম। গলার বেল্ট আর ঘণ্টা কিনে ফেললাম। বাচ্চাটির নাম রাখলাম “ধলু”। অনুমতি নিলাম বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। এরপর শুরু করলাম পরিচর্যা।
আমার সেই ধলু এখন অনেক বড় হয়েছে। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে দেখা হয়। আমাকে দেখলে ও চিৎকার করে দৌড়ে আসে। রোজ দু’টি বিস্কুট না দিলে অফিস যাওয়া চলে না। ধলু আমাকে আজও মনে রেখেছে। কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে মানুষকেই ভুলে যাই।
একদিন বাধ্য হয়ে ধলুকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। ধলু ওর মাকে দেখেই চেঁচাতে লাগল। মা লাফ দিয়ে উঠে এল রিকশায়। মা-ছেলের মিলনের দৃশ্য দেখে রাস্তায় জ্যাম লেগে গেল। ধলু এখন সেখানেই থাকে, কিন্তু আমার সঙ্গে সম্পর্ক রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই।
তবু এরা আমাদের সমাজে অবহেলিত প্রাণী। অথচ ওরা মানুষের ভালোবাসা কিছুতেই ভুলতে পারে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখে। কিন্তু মানুষ মানুষের ভালোবাসা ভুলে যায়। বেঈমানি করতেও দ্বিধা করে না। অথচ আমরাই বলি, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব!
✍️ কলমে—নিতাই বাবু✍️ লেখক পরিচিতি
নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু) একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্লগার ও সাহিত্যপ্রেমী। জন্ম: জুন ১৯৬৩, মহাতাবপুর, চৌমুহানী, নোয়াখালী। বর্তমান নিবাস: নারায়ণগঞ্জ শহর।পেশা: লেখক, ব্লগার, এবং সমাজ ভাবুক। লেখকের বিভিন্ন লেখায় গ্রামীণ জীবন, দরিদ্রতা, স্মৃতি ও সমাজবিচার স্থান পায়। তিনি bdnews24 ব্লগের একজন সুপরিচিত লেখক ও পাঠকের প্রিয় কলমশিল্পী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com