শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত


শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত

শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত, শীতলক্ষ্যার পানি এখন আর কেউ স্পর্শ করে না। শীতলক্ষ্যা বাঁচলে যে নারায়ণগঞ্জবাসী বাঁচবে, তা সবাই জানে, কিন্তু বাঁচানোর উদ্যোগ কারও নেই।

তবু শীতলক্ষ্যাকে নিয়ে একটু কান্নাকাটি করতে হয়, কারণ: শীতলক্ষ্যার সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক অনেক আগের—স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, যখন আমরা গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলে আসি তখন থেকেই।

স্কুলে আসা-যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মিলের প্রাচীর ঘেঁষা নদীর পাড়ের পরিত্যক্ত ছোট জায়গায় কিছু সবজির চারা রোপণ করতাম, শখের বশে। আদর্শ কটন মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমরা মিলে আর থাকতে পারিনি। মিল ছেড়ে চলে এসেছি ঠিকই, কিন্তু শীতলক্ষ্যা আমাকে ছাড়েনি। ভাগ্যের টানে যেখানেই গিয়েছি, ঘুরেফিরে আবার এই শীতলক্ষ্যার পাড়েই থাকতে হয়েছে আমাকে—কখনো এ পার, কখনো ও পার।

শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও প্রতিদিন একবার আমি শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে বসতাম। এখনো আমার সেই নিয়মটা বলবৎ আছে। দূরে থাকি আর কাছে থাকি, শীতলক্ষ্যার সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্কটা কিন্তু ছিন্ন হয়নি। সেই সুসম্পর্কের টানেই এখনো দিনে একবার শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে বসতে হয়। পাড়ে বসে শীতলক্ষ্যার আগের রূপের সঙ্গে বর্তমান রূপের পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করি আর ভাবি শীতলক্ষ্যাকে নিয়ে।

আগে যেমন সকাল-বিকাল, সময়-অসময় শীতলক্ষ্যায় ঝাঁপ দিয়ে নেমে পড়তাম, সাঁতার কেটে নদীর ওপারে যেতাম, আবার আসতাম—এখন আর তা হয় না। কারণ: শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত।

শীতলক্ষ্যার এখন আর আগের মতো রূপ-যৌবন নেই। মানুষ মারা গেলে কয়েকদিন পর যেমন দেহটা পচে দুর্গন্ধ বের হয়, শীতলক্ষ্যা থেকেও ঠিক তেমনই দুর্গন্ধ বের হচ্ছে সবসময়। এ যেন এক কুষ্ঠরোগী!

শীতলক্ষ্যার পানি সেই আগের মতো কেউ আর কলসিতে ভরে নেয় না। ছোটবেলায় দেখতাম, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ঘেঁষা গ্রাম থেকে মা-বোনেরা দলবেঁধে আসত স্নান করতে। সঙ্গে নিয়ে আসত মাটির কলস আর পিতলের কলস। সবাই স্নান করে যাওয়ার সময় শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ পানি কলসে ভরে নিয়ে যেত পরিবারের সবার পিপাসা মেটানোর জন্য।

শুধু গ্রামের মা-বোনেরাই নয়, শীতলক্ষ্যার পানি নিয়ে যেত তেলবাহী আর মালবাহী জাহাজের নাবিকরাও। শীতলক্ষ্যার পানি ছিল যেমন স্বচ্ছ, তেমনই পরিষ্কার ও মিষ্টি। এখন সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না কারও—পড়বেও না কোনোদিন। কারণ: শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত। শীতলক্ষ্যার এখন জীবন নেই।

শীতলক্ষ্যার বুক থেকে এখন পশু মরা পচা দুর্গন্ধ বের হয়, পচা দুর্গন্ধে আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে যায়। যেই পানির গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে, সেই পানি জাপানের তৈরি সুবিশাল পানি শোধনাগারেও শোধন করতে হিমশিম খায়। তাই এখন আর কেউ শোধন করা ছাড়া শীতলক্ষ্যার পানি পান করে না ভয়ে—করলেই নির্ঘাত মৃত্যু। কেউ স্নান করতে আসে না, শরীরে ঘাঁ হওয়ার ভয়ে।

কোনো ফসলি জমিতেও শীতলক্ষ্যার পানি দেয় না কৃষকেরা। বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পানি ফসলি জমিতে দিলে, জমিতে রোপণ করা ফসলি গাছ মরে যায়।

আগে দেখতাম, বিদেশ থেকে ইংরেজদের সঙ্গে মেমসাহেবরা আসতো স্পিডবোট নিয়ে শীতলক্ষ্যায় আনন্দ করার জন্য। স্পিডবোটের পেছনে রশি বেঁধে, পায়ে লম্বা জুতোর মতো কিছু লাগিয়ে পানির ওপরে রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। স্পিডবোট শোঁ শোঁ করে ছুটে চলতো, পেছনে রশি ধরে হাফপ্যান্ট পরা একজন মেমসাহেবও স্পিডবোটের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলতেন।

এখনকার ছেলে-মেয়েদের কাছে ওইসব কথা বললে, তারা মনে মনে বলবে—যা বলছি, সবই রূপকথার গল্প! সেজন্য আর কারও কাছে ওইসব কথা বলি না, সত্য বলেও হবো মিথ্যেবাদী। তাই আর কারও কাছে না বলে, মাঝেমাঝে শীতলক্ষ্যার কাছে গিয়ে নিজেই মনে করতে থাকি শীতলক্ষ্যার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। মনে করতে থাকি সেই আগের স্মৃতিগুলোকে, দেখতে থাকি শীতলক্ষ্যার পাড়—যা আজ মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে—সেই দৃশ্য।

যেখানে ছিল ফসলি জমি, সেখানে আজ বর্জ্যের স্তুপ আর ময়লার ভাগাড়। নাই পালতোলা গয়না নৌকা, দেখা যায় না দিনরাত জেলেদের মাছ ধরার জাল ফেলার দৃশ্য। বর্ষার আগমনের আগে দেখা যেতো নদীর পাড় ঘেঁষে জেলেদের বাঁশ দিয়ে ঘেরা চাক। সেই চাক থেকে বড় বড় মাছ ওঠানোর দৃশ্য—সেই দৃশ্য আর কারোর নজরে পড়ে না। যেই দূষিত পানিতে পোকামাকড় বাঁচে না, সেখানে মাছ থাকবে কী করে?

মাছ না-থাকার কারণে শীতলক্ষ্যার পাড়ের জেলেরা আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। তারা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে পদ্মা-মেঘনা পেরিয়ে দূরে কোথাও জলাশয়ে গিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। ছেলেপুলে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে কোনোভাবে। শীতলক্ষ্যার পাড়ে বহু জেলেপাড়া আছে, তার মধ্যে একটা জেলেপাড়ার নাম—গোদনাইল “হাজারীবাগ” জেলেপাড়া।

বর্ষার শুরুতে তাঁদের ঘরে ঘরে ছিল আনন্দমুখর পরিবেশ, সময়-অসময়েও ছিল তাদের পূজা-পার্বণের ধুম। এখন আর তাদের সেই আনন্দ নেই, অর্থাভাবে নিয়মের পূজাও করতে পারে না, অতিরিক্ত খরচ করবে কীভাবে? তাদের মাছ ধরার নৌকাগুলো সবসময় ঘাটেই বাঁধা থাকে। ওরা আর মাছ ধরার নৌকা নিয়ে রাতের আঁধারে হারিকেন জ্বালিয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মাছ ধরে না—ওরা চলে যায় দূরে, কোথাও অচেনা নদীতে।

আগের মতো নদীর প্রস্থও নেই, নদীর নাব্যতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বেদখলও হয়ে যাচ্ছে নদীর পাড়। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ। সেসব মিল-ইন্ডাস্ট্রিজের নির্গত বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি গড়াচ্ছে শীতলক্ষ্যার বুকে। নিধন হচ্ছে মাছ, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, মরছে জেলে সম্প্রদায়, আর পানি খেয়ে রোগাক্রান্ত হচ্ছি আমরা ও আমাদের সন্তানরা।

তবু নিরুপায় হয়ে শহরে বসবাসকারী মানুষ এই শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি পান করেই যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার এই আধুনিক সময়ে শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি পান করে না—যাদের টাকা আছে, তারা বাজারের ফিল্টার পানি পান করে সবসময়। মরছি শুধু আমরা, অসহায় গরিব মানুষরা—যাদের সীমিত আয়ের মধ্যে সংসার চলে।

আগে দেখতাম, নদীর মাঝখানে ড্রেজিং শিপ; মাসের পর মাস ধরে নদী ড্রেজিং করতো। এখন আর সেইসব চোখে পড়ে না। অথচ শীতলক্ষ্যার পাড়েই আছে ড্রেজার সংস্থা, যা হাজীগঞ্জ কিল্লার পুল সংলগ্ন সুবিশাল ড্রেজার অধিদপ্তর। এই ড্রেজার সংস্থায় আছে ড্রেজার শিপ ও ড্রেজার মেশিন মেরামতের কারখানা, এটিকে ড্রেজার ওয়ার্কশপও অনেকে বলে থাকে। নদীতে ড্রেজিং না থাকায় বর্তমানে নদীর গভীরতা দিনদিন কমে যাচ্ছে, বাড়ছে পাড়ের প্রস্থ—আর দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা।

বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড় বাঁধাইয়ের কাজ মোটামুটি সম্পন্ন হচ্ছে—সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় নদীভাঙন রোধে জিও ব্যাগ, পাথর ও কংক্রিট ব্লক বসানোর কাজ চলছে। তবে শীতলক্ষ্যার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু বাঁধাই নয়, প্রয়োজন দূষণ নিয়ন্ত্রণ।

শীতলক্ষ্যা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নরসিংদী, গাজীপুর, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী, যেই নদীটি নারায়ণগঞ্জের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে। জানা যায়, নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২২৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক শীতলক্ষ্যা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর ৫৫, উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী।

এই নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী। এর গতিপথের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পরে নারায়ণগঞ্জের পূর্ব দিয়ে কালাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে।

শীতলক্ষ্যা বাঁচলে আমরা বাঁচবো, শীতলক্ষ্যা বাঁচলে নারায়ণগঞ্জবাসী বাঁচবে।


✍️ লেখক: নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু) — লেখক, গবেষক, ব্লগার। তিনি নারায়ণগঞ্জভিত্তিক নদী ও স্থান-সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করেন। তাঁর ব্লগ: https://blog.bdnews24.com/nitaibabu

আপডেট: শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম দুই পাড়ের বাঁধাইয়ের কাজ সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে, যা নদীর সুরক্ষা ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।


প্রিয় পাঠক, আমার এই লেখাটি ভালো লাগলে দয়া-পূর্বক ছোট একটা মন্তব্য দানে বাধিত করতে ভুলবেন না।
সাথে মানুষের উপকারের জন্য লেখাটি আপনার বন্ধুমহলে শেয়ারের করে কৃতার্থ করবেন।

শেয়ার করুন—

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা