শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে থাকা এক ঐতিহ্য

 

শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে থাকা এক ঐতিহ্য

শীতলক্ষ্যা একটি নদীর নাম। যা নারায়ণগঞ্জ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে, যুগ যুগ ধরে। স্বচ্ছ পানির জন্য সুনাম অর্জনকারী শীতলক্ষ্যা নদী বঙ্গদেশের সবার কাছেই পরিচিত। স্বচ্ছ পানির সুনাম বর্তমানে না থাকলেও, নদীর দুই পাড় নিয়ে সুখ্যাতি আজও অখ্যাত রয়ে গেছে।

শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে রয়েছে প্রচুর মিল-ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আরও অনেক কিছু। এসব নিয়ে লিখে শেষ করা যায় না। তাই আর কিছু লিখলামও না। লিখতে চাই শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উপরে ভেসে থাকা বি.আই.ডব্লিউ.টি.সি’র ভাসমান ডকইয়ার্ড নিয়ে।

এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটিও প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের একটা ঐতিহ্য। যা যুগ যুগ ধরে শীতলক্ষ্যা নদী, আর নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য বহন করে চলছে। এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটি পানিতে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ-ইস্টিমার, কার্গো, ট্রলারসহ আরও বহুরকম নৌযান মেরামত করার সময়োপযোগী স্থান।

আমরা সবাই সচরাচর দেখি ডকইয়ার্ড থাকে নদীর পাড় ঘেঁষা খোলা জায়গায়। কিন্তু এটি নদীর পাড় ঘেঁষা কোনও খোলা জায়গা বা ভূমিতে নয়! এটি হলো পানির উপরে ভাসমান (ভেসে থাকা) অবস্থায়। নদীতে চলাচলকারী নৌযান মেরামত করার সহজ এবং উপযোগী স্থান।

জানা যায়, এরকম ভাসমান ডকইয়ার্ড এই বঙ্গদেশে আরও দু’টি আছে। একটি বরিশাল, আরেকটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। আর এটি হলো তৃতীয় ভাসমান ডকইয়ার্ড। এটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন। এটি বি.আই.ডব্লিউ.টি.সির নৌযান মেরামতের ইমার্জেন্সি বিভাগ হিসেবে পরিচিত ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ড

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই ডকইয়ার্ডটিকে। এই ডকইয়ার্ডের সাথেই ছিল আমাদের বসবাস, সাবেক আদর্শ কটন মিলস্—বর্তমান শোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস্। স্কুলে যাবার আগে বন্ধুদের সাথে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসতাম এই ডকে। এসেই সবাই মিলে শুরু করে দিতাম লাফালাফি আর ডকের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি।

এসব করার সময় কর্মরত কর্মচারীদের অনেক বকুনিও শুনেছি। আবার কোনও কোনওদিন বিকেলে মাছ ধরার জন্য বরশি নিয়ে চলে আসতাম ডকইয়ার্ডের সামনে। এই ডকের চারিপাশ ছিল মাছের অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের ছয় ঋতুর প্রায় সব ঋুতুতেই এর চারদিক মাছে থাকত ভরপুর। বরশি ফেলার সাথে সাথেই পাওয়া যেত নানারকম মাছ।

বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যত্রতত্র নিট গার্মেন্টস ও ডাইং কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব ডাইং কারখানার নির্গত কেমিক্যালের পানি শীতলক্ষ্যায় মিশে এখন পুরো নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। যার কারণে ডকের আশেপাশে আগের মতো মাছ থাকে না।

ডকইয়ার্ডের প্রযুক্তি ও কার্যপ্রণালী

জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আলফেজ উইলিয়ামস অ্যান্ড ডোভস লিমিটেড ১৯৪৫ সালে এটি নির্মাণ করে। জাহাজের ত্রুটিপূর্ণ তলদেশ মেরামত এবং দ্রুত বিকল ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর কাজে এই ডকের জুড়ি নেই।

এ ডকে ৫টি পন্টুন আছে। পন্টুনগুলোর ভিতরে বৈদ্যুতিক মোটরপাম্পের মাধ্যমে পানি ঢুকিয়ে ডককে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তখন ত্রুটি সারতে আসা জাহাজটিকে আরেকটি ছোট ইঞ্জিনচালিত জাহাজে ঠেলে ডকের ভিতরে এনে কাঠের স্তম্ভের উপর বসানো হয়।

এরপর পাম্প দিয়ে পানি সেঁচে ধীরে ধীরে ডকটিকে ভাসানো হয় এবং শুরু হয় মেরামতের কাজ। কোনও কোনও নৌযানকে এক মাসও রাখা লাগে। মেরামতের পর একই পদ্ধতিতে জাহাজটি পানি নামানো হয়।

ভাসমান ওয়ার্কশপ

ডকের সাথেই রয়েছে একটি সুবিশাল ভাসমান ওয়ার্কশপ। এখানে যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের কাজ হয়। এখানকার দক্ষ মেকানিকরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরি করে জাহাজ মেরামতের কাজে লাগান।

ঋতু ও নদীর পানি সমস্যা

ডিসেম্বর মাস এলেই নদীর পানি কমে যায়। তখন ডক ডুবাতে ও তুলতে সমস্যা হয়। কারণ চৌরাপাড়া গুদারাঘাটের কাছে নদীর পানি বর্ষা ছাড়া অনেকটাই কম থাকে। কখনো কখনো ডক মাটিতে ঠেকেও যায়। তখন কর্মচারীদের অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। জোয়ার এলেই আবার শুরু হয় ডক ডুবানো ও জাগানোর কাজ।

এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে ডকের কাজ। আর একইভাবে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের ঐতিহ্যও রক্ষা করে চলছে এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটি।

যেভাবে ভাসমান ডকইয়ার্ডটি যুগ যুগ ধরে শীতলক্ষ্যা নদীর বুকে ভেসে আছে, এভাবে যেন চিরদিন কালের সাক্ষী হয়ে শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে থাকে — সেই কামনা করি।


✍️ লেখক: নিতাই বাবু — একজন সময়নিষ্ঠ ব্লগার, যিনি নারায়ণগঞ্জ ও শীতলক্ষ্যার ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেন।

📢 পাঠকদের অনুরোধ: এই লেখাটি ভালো লাগলে মন্তব্য করুন, শেয়ার করুন এবং আপনার অভিমত জানাতে ভুলবেন না।

🔗 শেয়ার লিংক: জীবনের ঘটনা

🔗 শেয়ার লিংক: নিতাই বানু ব্লগ 

🔗 শেয়ার লিংক: চ্যাটজিপিটি ভাবনা 

পোস্টটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

Facebook Facebook Twitter Twitter WhatsApp WhatsApp Email Email

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা