স্মৃতির সন্ধ্যায় সুপারি গাছের খোলের জুতা


স্মৃতির সন্ধ্যায় সুপারি গাছের খোলের জুতা

১৯৬৭ সালের কথা। তখন আমি সদ্য প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। পিঠে বই-স্লেট ঝুলিয়ে প্রতিদিন খালি পায়ে ছুটে যেতাম স্কুলে। ক্লাস শেষ হলে দৌড়ে বাড়ি ফিরে সেগুলো একপাশে ছুঁড়ে রেখে ছুটে যেতাম মাঠে—সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে ডাংগুটি, গোল্লাছুট, নারকেল পাতার বাঁশি বানানো কিংবা সুপারি গাছের খোলের ওপর বসে টানা-টানির খেলায় মেতে উঠতাম।

সেই সুপারি গাছের খোল তখন গ্রামের মানুষের জন্য ছিল এক অমূল্য সম্পদ। গৃহস্থের ঘরে কাজে এর ছিলো নানা ব্যবহার—চিকন করে কেটে দড়ি বানিয়ে বাঁশের বেড়া বাঁধা, টুকরি তৈরি, ছনের ছাউনি বাঁধা, কুলা বানানো—এমনকি পায়ের জুতা বানাতেও এর ব্যবহার হতো।

আমাদের সময়ে টাকার বড়ই টানাটানি ছিলো। অভাব ছিল যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। নতুন জামা-প্যান্ট বা জুতা কেনার কথা কল্পনাতেও আসতো না। আমার নিজের অবস্থাও ছিল ঠিক তেমন—ছেঁড়া-ফাটা জামা আর খালি পায়ে হাঁটা ছিল জীবনের স্বাভাবিক চিত্র।

তবে স্কুলে গিয়ে যখন দেখতাম কিছু ছেলেমেয়ের পায়ে প্লাস্টিকের রঙিন স্যান্ডেল, তখন মন কেমন করে উঠতো। বাড়ি ফিরে কাঁদতাম—“মা, আমাকেও স্যান্ডেল কিনে দাও।” মা তখন মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “তোর বাবা বাড়ি এলে কিনে নিয়ে আসবে রে।” এই আশ্বাসেই শান্ত হতাম, আবার পরদিন খালি পায়ে হেঁটে চলে যেতাম স্কুলে।

সন্ধ্যাবেলা বাড়ির কাজকর্ম শেষ হলে মা কিংবা বড় দিদিরা আমাকে কোলে করে পুকুরঘাটে নিয়ে যেতেন। পা ধুয়ে আবার কোলে করেই নিয়ে আসতেন ঘরে। তাঁদের পায়েও ছিল না কোনো প্লাস্টিক বা চামড়ার জুতা। তারা ব্যবহার করতেন সুপারি গাছের খোল দিয়ে বানানো জুতা। সেই খোলের জুতায় ছিলো স্নেহ, মমতা, আর সহজ জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি।

তবে রোজ কোলে চড়ে পুকুরঘাটে যাওয়া আমার ভালো লাগতো না। একদিন রাগ করে মাটিতে বসে কান্না শুরু করলাম—“আমি আর কোলে যাব না। আমাকে খোলের জুতা বানিয়ে দাও!”
মা হেসে ফেললেন। পরদিন বিকেলেই সুপারি গাছের খোল কেটে আমার জন্য ছোট্ট এক জোড়া জুতা বানিয়ে দিলেন।

সেই জুতা পরে আমি গর্বে বুক ফুলিয়ে সন্ধ্যায় পুকুরঘাটে গেলাম, পা ধুয়ে এসে উঠোনে হেঁটে বেড়ালাম। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে খোলের জুতা জোড়াটি যত্ন করে ঘরের এক পাশে তুলে রাখতাম, যেন কোনো দামী ধনসম্পদ!


✍️ লেখক পরিচিতি:
নিতাই বাবু — একজন স্মৃতিমন্থনকারী গল্পকার ও ব্লগার, যাঁর লেখায় উঠে আসে শৈশবের টুকরো টুকরো জীবনচিত্র, বাংলার গ্রামীণ বাস্তবতা এবং আবেগঘন পারিবারিক টানাপোড়েন।

📣 পাঠকের প্রতি আহ্বান:
আপনার শৈশবেও কি এমন খোলের জুতার গল্প আছে?
মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না! আর ভালো লাগলে শেয়ার করুন প্রিয়জনদের সঙ্গে।

📢 পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

Share on Facebook Share on Twitter Share on WhatsApp

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা