পোস্টগুলি

ভুলে থাকা যায় না

ছবি
ভুলে থাকা যায় না লিখেছেন: নিতাই বাবু ১৯৮৪ সালের শুরু। নারায়ণগঞ্জের গলাচিপা গোয়ালপাড়ায় বড়দার সংসারে থাকতাম মা-সহ। আয়-রোজগার নিয়ে কথাকাটাকাটির পর মা'কে নিয়ে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। নগর খাঁনপুরে হিন্দু ভাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে এক ঘর ভাড়া নেই—মাসিক ভাড়া মাত্র ১৫০ টাকা। তখনও আমি অবিবাহিত। চাকরি করি কিল্লার পুলের ফাইন টেক্সটাইল মিলে—বেতন ২০০০ টাকা। মা আর আমি—দুজনের সংসার ভালোভাবেই চলতো। বাসায় ওঠার দিন ছিল শুক্রবার। রিকশায় করে সামান্য মালপত্র নিয়ে এলাম নতুন ঠিকানায়। বাড়ির সামনে পুকুর, আর তার পাশেই রাস্তা ও ভাড়া বাসা। মাল নামানোর সময়ই নজরে পড়লো এক অপার রূপবতী মেয়ের দিকে—গায়ের রং ফর্সা, হাঁটুর নিচ পর্যন্ত চুল, দেবীমূর্তির মতো চেহারা। বারবার আমাদের দিকেই তাকাচ্ছে। আমার সহচর ছিল কানাই লাল—এই এলাকা সম্পর্কে পূর্বপরিচিত। ও-ই বাসা খুঁজে দিয়েছিল। মাল উঠাতে গিয়ে সংকোচ হচ্ছিল—আমাদের গরিবি জিনিসপত্র অন্য ভাড়াটিয়াদের তুলনায় লজ্জাজনক মনে হচ্ছিল। তখনই মেয়েটি এসে বললো, “আপনারা না পারলে আমি সাহায্য করবো?” আমরা না করলেও সে একটি বস্তা হাতে করে ঘরে রেখে এলো। ...

জীবনের গল্প-২

ছবি
                   শ্রী নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু) জীবনের গল্প-১ শেষাংশ ↓↓ থাকতাম মিল অভ্যন্তরে শ্রমিক ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। সময়টা তখন হতে পারে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর নাহয় ডিসেম্বর মাস। জীবনের গল্প-২ আরম্ভ ↓↓ গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পর প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত আমার কোনও বন্ধুবান্ধব তো ছিল না,  এমনকি মিলের ভেতরে থাকা শ্রমিক কোয়ার্টারের কোনও সমবয়সী ছেলে আমার সাথে কথাও বলতো না।  আমিও মিলের ভেতরে থাকা ওদের সাথে বেশি মিশতাম না। কারণ আমার নোয়াখালীর ভাষা ওরা কেউ বুঝতো না। আমি কিছু বলতে গেলেই আরও চার-পাঁচজন হিহিহি করে হাসতো। ওরা আমাকে দেখলেই নোয়াখাইল্লা নোয়াখাইল্লা বলে হাসাহাসি করতে।  আবার আমার চেহেরাটা বেশি সুশ্রী ছিল না বলে, ওরা আমাকে দেখে ভেংচি দিতো। আসলে ওদের কোনও দোষ ছিল না। দোষ ছিল আমার কুশ্রীত চেহারার। আমার মুখমণ্ডল আরও দশজনের চেয়ে অন্যরকম ছিল। মানে কুশ্রী।  চেহারা কুশ্রী হওয়ার কারণ হলো, আমার বয়স যখন চার বছর; তখন নাকি আমি গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিনমাস পর্যন্ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে রোগমুক্ত ...

জীবনের গল্প-১

ছবি
                               শ্রী নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু) নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন একটি ছোট গ্রামের নাম মাহাতাবপুর। মাহাতাবপুর গ্রামটি হলো বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে।  সেই গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম। আমার জন্ম ৮ই জুন, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। আমার বাবার বাপদাদার আমলটা নিজের চোখে না দেখলেও, তাঁদের সময়টা খুবই ভালো ছিল বলে মনে হয়।  কারণ, মাহাতাবপুর গ্রামে আর কারোর বাড়িতে দালান ঘর ছিল না। দালান ঘর শুধু পুরো গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িতেই ছিল। তাও আবার ঘরগুলো ছিল চাটগাঁর (চট্টগ্রামের) পাহাড়ি মাটি দিয়ে তৈরি।  ঘরগুলো দেখতে হুবহু গুদামঘরের মতনই দেখা যেতো। যার কারণে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় আমাদের বাড়ির নাম ছিল মাইডগা গুদাময়ালা বাড়ি।  আমার দাদার নাম ছিল পঞ্চনন্দ পাল। বাবার নাম শচিন্দ্র চন্দ্র পাল। আমার বাবার আরও দুই ভাই ছিল। মেজো কাকা যতিন্দ্র চন্দ্র পাল। ছোট কাকার নাম ছিল, শান্তিরঞ্জন পাল।  আমরা ছিলাম চার বোন, দুই ভাই। নিমাই চন্দ্র পাল, রাধা (রাধু) র...

গ্রাম ছেড়ে কেন আসলাম কংক্রিটের শহরে

ছবি
গ্রাম ছেড়ে কেন আসলাম কংক্রিটের শহরে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে এক ছোট্ট গ্রাম— মাহাতাবপুর । সেখানেই আমার জন্ম, ১৯৬৩ সালের ৮ই জুন, এক হিন্দু পরিবারে। চোখে না দেখলেও, আমার ঠাকুরদা-পিতামহদের সময়কাল যে অনেক ভালো ছিল, সে ইঙ্গিত মেলে আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া বাড়ি দেখলেই। পুরো গ্রামে তখন শুধু আমাদেরই দালান ঘর ছিল— চট্টগ্রাম থেকে আনা পাহাড়ি লালচে মাটি দিয়ে তৈরি সেই ঘরগুলো দেখতে ছিল অনেকটা গুদামঘরের মতো। গ্রামের মানুষের মুখে তাই আমাদের বাড়ির নাম ছিল “মাইডগা গুদামওয়ালা বাড়ি” । আমার দাদার নাম ছিল পঞ্চনন্দ পাল, বাবার নাম শচিন্দ্র চন্দ্র পাল। আমরা ছিলাম চার বোন, দুই ভাই। আমি নিতাই চন্দ্র পাল— সবার ছোট। শুনেছি, আমার ঠাকুরদা চট্টগ্রাম থেকে পণ্য কিনে এনে চৌমুহনী বাজারে বিক্রি করতেন। দোকান, গোডাউন ছিল তার। মাসে বেশ ক'দিন তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন, আর সেখান থেকেই এনে দিয়েছিলেন আমাদের সেই বিখ্যাত ঘরের মাটি ও কারিগর। আমাদের পরিবারের দালান ঘরগুলো ছিল মাটি দিয়ে তৈরি হলেও বেশ মজবুত— দেয়াল ছিল প্রায় দুই হাত পুরু । ঘরগুলোর ভিতরে আলাদা আলাদা কক্ষ, উঠোন ...

সেবক ব্রিজ— পাহাড়, নদী ও অদেখা সিকিম

ছবি
শিলিগুড়ি থেকে বীরপাড়া যাবার পথে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্য চোখে পড়ে, তার অন্যতম নিদর্শন হল সেবক রোড এবং তার বুকে গড়া সেবক ব্রিজ । এই জায়গাটি শুধু একটি যাতায়াতের মোড় নয়, বরং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও হিমালয়ের পাদদেশীয় এলাকার এক গভীর সংযোগস্থল। সেবক রোড শুরু হয় শিলিগুড়ির ব্যস্ত শহরাঞ্চল থেকে, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নগরের কোলাহল পেছনে ফেলে মানুষ প্রবেশ করে প্রকৃতির শান্ত নিসর্গে। এই পথের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ স্থান হলো সেবক ব্রিজ। এটি তিস্তা নদীর উপর নির্মিত এক চমৎকার সেতু, যা শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়, প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকেও এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। সেতুটির এক পাশে রয়েছে সিকিমে যাবার পথ , যা পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। আর মাঝ বরাবর, সেবক ব্রিজের এক কোণ ঘেঁষে চোখে পড়ে এক অনুচ্চ পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক কালীমন্দির । মন্দিরটির অবস্থান এমন যে, মনে হয় যেন মা কালীর কৃপাদৃষ্টি সারা সেবক রোড ও ব্রিজজুড়ে বিস্তৃত। ভক্তরা প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে মন্দিরে পুজো দিয়ে যান, সেখান থেকে চারপাশের প্রকৃতি উপভোগ করেন। পাহাড়, নদী ও মন্দির—এই ত্...

সাধু: বাঙালির অন্তর্মূল্য ও উভয়তার দর্শন

ছবি
✍️ নিতাই বাবু ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের বিষয়ে আমার একটা গভীর আগ্রহ বহুদিনের। “আমরা কে?”, “আমাদের স্বভাব কোথা থেকে এসেছে?”, “বাংলা শব্দের ভেতরে কী ইতিহাস লুকিয়ে আছে?” — এই প্রশ্নগুলো আমাকে বারবার নাড়া দেয়। সম্প্রতি রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খানের 'শব্দার্থ পরিক্রমা' পড়ে মনে হলো, আমাদের শব্দগুলো শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এরা একেকটি জীবনদর্শন। এই ভাবনা থেকেই ‘সাধু’ শব্দটির দিকে মন গেল। কী আশ্চর্য—একটি ছোট্ট শব্দের মধ্যে কতটা সমাজতত্ত্ব, দর্শন ও ইতিহাস গাঁথা! সেই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করেই এই প্রবন্ধটি রচনা করেছি। ভাবনার গঠন ও ভাষার বাঁধন দিতে আমার ডিজিটাল সহযোগী ‘চ্যাটজিপিটি’ পাশে ছিল। তবুও এটি আমার মনের কথা, আমার আত্মান্বেষণেরই প্রকাশ। আশা করি, পাঠক হৃদয়েও এই লেখাটি একধরনের চিন্তার স্পন্দন তুলবে। ভালো লাগলে মন্তব্য জানাবেন, মতামত জানাবেন—কারণ বাংলা ভাষা আর বাঙালিয়ানা নিয়ে আলোচনা যত বাড়বে, ততই আমরা নিজেদের চিনতে পারব। উভয়ের মহিমা : ‘সাধু’ শব্দার্থের সন্ধানে — অনুপ্রেরণায়: রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান ‘সাধু’—শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখে ভেসে ওঠে শান্ত মুখ, ত্যাগ...

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা

ছবি
        আমার একমাত্র মেয়ে, অনিতা রাণী বিশ্বাস।  আমার বিবাহের তারিখ, ১৪ জুন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ, পহেলা আষাঢ়, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ। বিয়ে করেছিলাম, মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখাঁন থানাধীন সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামের এক দরিদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়ে।  আমার বিয়ের পর প্রায় আড়াই বছর পর ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে আমার একমাত্র মেয়ে অনিতা'র জন্ম হয়। মেয়ে অনিতা ভূমিষ্ঠ হয়, নারায়ণগঞ্জ সিটির ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। তখন আমার গর্ভধারিণী মা জীবিত ছিলো। বাবা ছিলেন পরপারে।  আমি তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ১০নং ওয়ার্ড গোদনাইলস্থ কো-অপারেটিভ মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে নামমাত্র বেতনে চাকরি করি। সন্তান  ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পেয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী হাসপাতালের সিটে সন্তান পাশে রেখে শুয়ে আছে। মা স্ত্রীর সিটের পাশে বসা। আমি সামনে যাওয়ার সাথে সাথে মা হেসে বললো, "এতক্ষণে এলি? আয় দেখ তোর সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে।"  মেয়ের কথা শুনেই আমি কেঁদে ফেললাম! আমার দু'চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। মা আমার কাঁদা দেখে এক ধমক দিয়ে বললো, "এ-ই, কাঁদিস কেন?...