জীবনের গল্প-২৪

                     শ্রী নিতাই চন্দ্র পাল (নিতাই বাবু)

জীবনের গল্প-২৩ শেষাংশ↓↓

জীবনের গল্প-২৪ আরম্ভ↓↓
আমি কানাইর সাথে যখন ভারত গিয়েছিলাম তখন ১৪০০ বঙ্গাব্দ, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। দেখলাম ব্রজিটিতে তখন কোনও ভারি যানবাহন চলাচল করে না। এর মূল কারণ হল, ব্রিজটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তাই। এটি কোনও একসময় বিধ্বস্ত হয়ে যাবে বলে ভারতের বড় বড় প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ারদের ধারণা। 

তাই ভারত সরকার ব্রিজটির পাশে আরেকটি ব্রিজ তৈরি করে রাখে। সেই ব্রিজটি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে নামকরণ করে রাখা হয়, বিদ্যাসাগর সেতু। হাওড়া ব্রিজ থেকে একটু ডানদিকে তাকালেই বিদ্যাসাগর সেতুটি দেখা যায়। 
কানাই বলল, “তোকে যদি রাতের বেলা এখানে আনতে পারতাম, তাহলে আরও ভালো লাগত। এখানে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর সেতু যেভাবে দেখছিস, রাতে আরও সুন্দর দেখায়। তখন মনে হয় না যে, আমরা ভারত আছি। মনে হয় ইউরোপের কোনও এক শহরে দাঁড়িয়ে আছি!”

নিজ চোখে দেখলাম হাওড়া ব্রিজ! পায়ে হেঁটে গেলাম ওপারে, আবার আসলামও পায়ে হেঁটে। তখন সূর্যটা ঢুববে ঢুববে মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আরেকটু দেরী করে রাতের সৌন্দর্যটা উপভোগ করি। 

কিন্তু তা আর হল না কানাইর জন্য। ও আমাকে সিনেমা দেখাবে, তাই তাড়াতাড়ি করে ট্রামে ওঠল। যাবে টালিগঞ্জ। সেখানে গিয়ে শাহরুখ খান অভিনীত “বাজিগার" ছায়াছবি দেখাবে।

যেই কথা সেই কাজ! হাওড়া থেকে ট্রামে চড়ে গেলাম ধর্মতলা। সেখান থেকে বাসে চড়ে গেলাম টালিগঞ্জ।ছায়াছবি দেখা হবে, মেনকা সিনেমা-হলে। সিনামা দেখবো রাত্রিকালীন শো। শো আরম্ভ হবে রাত ৯ টায়, শেষ হবে রাত ১২টায়। ছায়াছবি ‘বাজিগার’ নায়ক শাহরুখ খান, নায়িকা কাজল অভিনীত। দেখলাম, ভারতের সিনেমাহলে বড় পর্দায় সিনেমা। 

খেয়াল করলাম, সেখানকার মানুষ খুবই সংস্কৃতি প্রিয়। একবেলা খাবার না খেয়ে, সেই টাকা দিয়ে তারা সিনেমা দেখে। এমনও পরিবার দেখেছি, তাদের রান্না-বান্না চলে পাথর-কয়লা দিয়ে। সেই পাথর-কয়লা থেকে একটি-দুইটি করে কাঁচ-কয়লা প্রতিদিন রেখে দেয়। 

যখন একদিন রান্না করার মত কয়লা জমা হয়ে যায়, তখন গৃহিণী তার স্বামীর কাছ থেকে সেই টাকা আদায় করে নেয়। পরে সেই টাকা দিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনে গিয়ে সিনেমা দেখে। যেদিন সিনেমা দেখবে, সেদিন ঘরে ফিরে আর রান্না-বান্না করবে না। সিনেমা দেখে আসার সময় কিছু চানাচুর বা বিস্কুট সাথে নিয়ে এসে তা-ই খেয়ে থাকবে। তবু সিনেমা দেখা চাই-ই-চাই। 

এ ছাড়াও যেকোন সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলে-দলে যোগদান করে থাকে। যেমন- যাত্রাপালা, লোকনাট্য, থিয়েটার, কবিগান সহ নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আর আমাদের দেশে বর্তমানে সিনেমা হলে তো কেউ যায়-ই না। অনেক স্থানে দর্শক সংকটে সিনেমা হল প্রায় সবই বন্ধ!

যাক সে কথা। সেদিন টালিগঞ্জ মেনকা সিনেমাহলে সিনেমা দেখে বাসায় ফিরতে রাত হয়েছিল প্রায় দেড়টা। কানাই আগেই জানত যে, এত রাতে বাসায় গেলে বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকবে। তাই সিনেমা দেখে আসার সময়ই দুইটা পাউরুটি কিনেছিল। বাসায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে একটা পাউরুটি খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুলাম। 

কিন্তু কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না, মনটা কেমন যেন ছটফট করছে। মনে পড়ছে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা, আর দাদা বৌদির কথা। আবার ভাবছি নিজের পকেটের কথাও! ভাবছি যেখানে যাব সেখানকার কথা। এই ঘুরা-ঘুরির মধ্যে নিজের বেশকিছু টাকা খরচও হয়ে গেল। 

এভাবে পকেট শূন্য হয়ে গেলে কানাই যদি সহযোগিতা না করে? হয়ত করবে। তা-ও ক’দিন করবে? ওরও তো এখানে একটা সংসারের মতো আছে। যদিও বিয়েশাদী এখনও করেনি, তাতে কী হয়েছে? দুইটা বোন তো সাথে আছে! আমাকে একা বাসায় রেখে কানাইও কোনও কাজে কর্মে যেতে পারছে না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তা নিজেও জানিনা।

এভাবে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে করতে কেটে গেলো প্রায় পাঁচ দিনের মতোন। ছয় দিনের মাথায় কানাই বলল, “তাড়াতাড়ি জামাকাপড় নিয়ে রেডি হয়ে নে, ফুলিয়া যাবো।”
কানাইর কথা শুনে আমি জামাকাপড় ব্যাগের ভেতরে ভরে প্রস্তুত হলাম। বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। কানাইর দুবোনকে বললাম, “এক দেশ থেকে আরেক দেশে এসেছিস, ভালোভাবে চলাফেরা করবি। এমনভাবে চলবি, যাতে অন্য কেহ কোনও খারাপ মন্তব্য না করতে পারে।”
এরমধেই কানাই রেডি হয়ে আমাকে ডাকল!  আমি কানাইর সামনে এসে বললাম, “আমি রেডি আছি, চল বাইর হই!”

কানাইর ভাড়া বাসা থেকে শিয়ালদা রেলস্টেশন অনেকদূর। এতদূর রিকশা যাবে না, তাই একটা অটোরিকশা রিজার্ভ নিলাম। তবুও শিয়ালদা যেতে বেজে গেল সকাল ১০টা। শিয়ালদা থেকে ফুলিয়া যেতে সময় লাগল, ২ ঘণ্টার মতো। 

ফুলিয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার একটা থানা এলাকা। ফুলিয়া রেলস্টেশনের একটু পূর্বদিকে গেলেই রতন চক্রবর্তীর বাড়ি। কানাই আমাকে নিয়ে গেল রতনদার বাড়িতে। আসলে রতনদার কোনও বাড়ি নেই! আছে শুধু বাড়ি করার মতো একটুখানি জায়গা।

বর্তমানে যেই লোকটা রতনদার জায়গা দেখবাল করে তার নাম গৌরাঙ্গ। একসময় এই গৌরাঙ্গ দাদা আমার খুবই কাছের মানুষ ছিলো। আগে বাংলাদেশে থাকতে একই মহল্লায় আমরা বসবাস করতাম। তিনি যে রতনদার জায়গা দেখাশোনা করছে, তা আর আমার আগে জানা ছিল না।

গৌরাঙ্গ দাদা আমাকে দেখেই বলল, “কী রে, কেমন আছিস? কীভাবে এলি। বাসার সবাই কেমন আছে।”
বললাম, “হ্যাঁ দাদা, আমি ভালো আছি, আর বাসার সবাই ভালো আছে। এখানে এসেছি কানাইর সাথে। তো আপনি কেমন আছেন? বৌদি কোথায়?”
গৌরাঙ্গদা বললো, “সবাই ভালো আছি।"
কথা বলতে বলতে ঘর থেকে পিঁড়ি এনে দিয়ে বলল, “বস।” 
তখন গৌরাঙ্গদা'র বউ (বৌদি) বাসায় ছিল না। বৌদি গেছে কোনও এক জায়গায় বেড়াতে। এরপর কানাই গৌরাঙ্গ দাদাকে বিস্তারিত খুলে বলল। গৌরাঙ্গ দাদা শুনলেন। কানাইর কথা শুনে গৌরাঙ্গ দাদা বললো, “বেশতো, ভালো করেছিস। এবার ওকে রতনের জায়গায় একটা ঘর তৈরি করে দে, ও থাকুক।”

কানাই কোনও কথা বলছে না, চুপ করে বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে রে? আমি তো কিছু বুঝে ওঠতে পারছি না।”
কানাই আমাকে বললো, “কিছু একটা তো হয়েছে রে। খেলা দেখাব, রতন না হয় রতনের বউকে।”
আমার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। তারপরেও আমি বললাম, “রতনদা'র ঘর কোনটা গৌরাঙ্গ দাদা? রতনদার ঘরে গিয়ে একটু বসি। এখানে থাকি বা না থাকি, রতনদার ঘরটা দেখেই যাই।”
গৌরাঙ্গদা বললো, “রতনের ঘর তো তার জমিতে পরে আছে, ঠেলে ওঠাতে হবে। কানাইকে বল ঘরখানা ওঠানোর ব্যবস্থা করতে।”
গৌরাঙ্গদা'র কথা শুনে কানাই বললো, “হয়েছে আর ঘর দেখতে হবে না, দেখবো এবার রতনকে।”
আমি কানাইকে বললাম, “কানাই তুই এখানে থাকিস, অথচ তুই কিছুই জানিস না! এটা কী বিশ্বাসযোগ্য?” আমার কথা শুনে কানাই বললো, ”বিশ্বাস কর আমি জানি না যে, রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নেই। যদি জানতাম, তা হলে অন্তত আমি তোকে আমার সাথে আনতাম না।“

কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, “যা হবার হয়েছে এখন তোর বাসায় চল। আগামীকাল একটু কষ্ট করে দেখবি, কোনও মিলে সিট খালি আছে কি না। যদি এখানে কোনও কাপড়ের মিলে চাকরি না পাই, তা হলে আমি চলে যাবো  দিদির বাড়িতে।”
আমার কথা শুনে কানাই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হয়ত আমার কথায় ওর একটু লজ্জাবোধ হচ্ছিল। লজ্জা তো পাবার কথাই, কারণ ও-ই-তো আমাকে এখানে আনলো। আর রতন চক্রবর্তীর সাথে ও-ই কথা পাকাপাকি করেছিল। এখন আমার কথায় ওর একটু লজ্জা লাগা স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ পর কানাই আমাকে বললো, “শুন, কষ্ট করে যখন এখানে এসেছিস, তো একটা কিছু করতেই হবে। দরকার হয় ট্রেনে, বাসে, ট্রামে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করবি। একটু কষ্ট আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেই, এখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারবি।”
কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, “তা পরে দেখা যাবে, এখন অন্তত এখান থেকে চলে যাই।”

কানাই বললো, “যাব, আগে তোকে নিয়ে ফুলিয়া এলাকাটা একটু দেখাই। এখানে ছোট ছোট অনেক টেক্সটাই মিল আছে। যদি কপাল ভালো হয়, আর যদি একটা মিলে কাজ হয়ে যায় ক্ষতি কী? তাহলে রতন চক্রবর্তীর আর দরকার হবে না।”
আমি বললাম, “চল তাহলে। বেলা অনেক হয়েছে, আবার তো বাসায় ফিরতে হবে।”
কানাই বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে চল।”
এরপর কানাই আর আমি গৌরাঙ্গ দাদার কাছ থেকে বলে-কয়ে বিদায় নিলাম। 

আসলাম ফুলিয়া রেলস্টেশন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হবার পালা। ক্ষিদে পেয়েছিল খুব! কানাইকে কিছু না বলার আগেই, কানাই বুঝতে পেরেছে। কানাই আমাকে বললো, “দেখ, এটা ভারত। এখানে মানুষ খুবই হিসাব করে চলে। গৌরাঙ্গ দাদা আমাদের খুবই কাছের লোক হয়েও দুপুরের খাবারের কথা কিছু বলল না। আর আমাদের বাংলাদেশ হলে কী হতো? নিজেরা না খেয়েও অতিথিকে খেতে দিতো।”
বললাম, “যা হবার হয়েছে, এখন চল একটা হোটেলে যাই। আগে কিছু খেয়ে নেই।”

গেলাম ফুলিয়া রেলস্টেশনের বাইরে! খাবারের কোনও হোটেল নেই। ফুলিয়া হলো মফস্বল এলাকা। এখানে বহিরাগত মানুষের বসবাস কম। হোটেলে কেউ খাবার খেতে আসে না। তাই হোটেলের ব্যবসাও কেউ করে না। অথচ এই ফুলিয়া রেলস্টেশনের একটু পশ্চিমে কোলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার মেইন রোড। 

আছে বাসস্টপ আর অনেক বড় বাজার। তবু একটা খাবারের হোটেল নেই। আছে দুই একটা চা দোকান আর কয়টা মিষ্টির দোকান। হোটেল খুঁজে না পেয়ে একটা চা দোকানে গেলাম। চা দোকান থেকে দুইটা পাউরুটি কিনে গেলাম মিষ্টির দোকানে। মিষ্টির দোকান থেকে দুইজনে চারটে মিষ্টি নিয়ে পাউরুটি দিয়ে খেলাম।

এরপর কানাই আমাকে নিয়ে গেল একটা টেক্সটাইল মিলে। এই কাপড়ের মিলে তৈরি হয় ৬০ কাউন্টের সুতার গ্রে মার্কিন কাপড়। এই কাপড়গুলো ডাইং ও প্রিন্ট করে প্রস্তুত করা হয় শাড়ি। মিলে গিয়ে কানাই কর্তব্যরত সুপারভাইজারের সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করলো। 

সুপারভাইজার আমাকে একটা চালু তাঁতের সামনে নিয়ে গেলো। সাথে কানাইও আছে। সুপারভাইজার আমাকে বললো, “মেশিনটা বন্ধ করুন তো!"

আমি সাথে সাথে মেশিনের হেন্ডেল ধরে চালু মেশিনটা বন্ধ করলাম। মেশিনটা বন্ধ করে পাঁচ মিনিট পর আবার চালু করে দিলাম। মেশিন চলছে। আমার মেশিনে হেন্ডেল ধরা দেখেই সুপারভাইজার বললো, “এই তো দেখছি তাঁতের ওস্তাদ। আগে কোথায় কাজ করেছে?”
কানাই বললো, “আপনাকে তো আগেই বলেছি, ও বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এখন আপনাদের মিলে কি কাজ করা যাবে?”
সুপারভাইজার বললো, “বর্তমানে আমাদের এখানে কোনও সিট খালি নেই। সিট খালি হতে আরও মাসেকখানি দেরি হতে পারে।”

সুপারভাইজার এসব বলার পর আমরা তাকে আর কোনও অনুরোধ করিনি। আমরা সোজা মিলের বাইরে চলে এলাম। অবশ্য কানাই বলেছিলো আরও দু'একটা মিলে গিয়ে দেখতে। কিন্তু আমি আর কোনও মিলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করিনি।
চলবে...

ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা