ছোটবেলার স্মৃতিগুলো

 

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো

নোয়াখালী জেলার মাহাতাবপুর গ্রামে ছিল আমার বাপদাদার ভিটেমাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন ৮/৯ বছরের নাবালক শিশু। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হবার আগে এবং পরের সময়েও এ দেশে টাকার খুবই দাম ছিল, মানও ছিল। যাঁর-তাঁর কাছে এতো টাকা-পয়সা ছিল না। কথায় আছে, “যাঁর কাছে হাজার টাকা ছিল, তাঁর টাইটেল ছিল হাজারী।” আর যাঁর কাছে লক্ষ টাকা ছিল, তাঁকে লোকে বলতো “লাখপতি।” তখনকার সময়ে কোটিপতির তালিকায় এ দেশে কারোর নাম ছিল না বলেই মনে হয়।

যাক সে কথা। আসি নিজের কথায়! নিজের কথা হলো, আমার ছোটবেলার কিছু সুখ-দুঃখের আনন্দের কথা। সেসব কথা মনে পড়লে আজও আমাকে কাঁদায়। এখনো যেকোনো পূজাপার্বণে ছোট ছেলে-মেয়েদের পূজোর আনন্দ উপভোগের সাজসজ্জা দেখে নিজের ছোটবেলার দিকে ফিরে তাকাতে হয়।

নোয়াখালী জেলার মাহাতাবপুর গ্রামে ছিল আমার বাপদাদার ভিটেমাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন ৮/৯ বছরের নাবালক শিশু। আমি ছোট থাকতে দেখেছি, আমাদের গ্রামে দুর্গাপূজা হতো না। দুর্গাপূজা হতো টাউনে। গ্রামে হতো লক্ষ্মীপূজা। এর কারণ আগেই বলেছি—তখনকার সময়ের টাকার খুবই দাম ছিল, মানও ছিল। দুর্গাপূজা করতে হলে অনেক টাকা-পয়সার দরকার হতো, যা সেসময় পুরো একটা গ্রামে থাকা সব পরিবার মিলেও বহন করতে পারতো না।

তাই আমাদের গ্রামের মতো অনেক গ্রামেই তখন কেউ দুর্গাপূজা করতো না বা করার সাহসও পেতো না। যদিও দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত একটি ধর্মীয় উৎসব এবং দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই ছিল প্রচলিত। তবুও তখনকার সময়ে আর্থিক দুরাবস্থার কারণে হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ এই ধর্মীয় দুর্গোৎসবটি অনেক গ্রামেই বাদ থেকে যেত।

এই ব্যয়বহুল সামাজিক ধর্মীয় উৎসবটি বাদ রেখে করা হতো লক্ষ্মীপূজা। তবে কিছু আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা পরিবার চৌমুহনী টাউনে গিয়ে দুর্গাপূজা দেখতো, আনন্দ করতো। আর যাঁদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো ছিল, তাঁরা থেকে যেতেন লক্ষ্মীপূজার আশায়। লক্ষ্মীপূজা হতো দুর্গাপূজার পরেই—অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শুরু হওয়া দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে। এই লক্ষ্মীপূজাতেই ছিল সে-সময় আমাদের সবচেয়ে আনন্দ-উৎসব।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে যখন দুর্গাপূজা আরম্ভ হতো, তখন থেকেই আমাদের গ্রামের সবাই ব্যস্ত থাকতো লক্ষ্মীপূজার আয়োজন নিয়ে। এসব আয়োজনের মধ্যে থাকতো—পরিবারের সকলের জন্য যাঁর যাঁর সাধ্যমতো কম-বেশি নতুন জামাকাপড় কেনা বা বানানো এবং লক্ষ্মীপূজা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করা। সাথে মা-বোনেরা সবাই চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া, নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু ও নানারকম সন্দেশ বানানোর কাজে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। যাঁদের অভাব-অনটন ছিল না, তাঁরা লক্ষ্মীপূজার দিনে অনেক করতেন। যাঁদের তেমন কিছু ছিল না, তাঁরা নামমাত্র অল্প কিছু করতেন। তবুও কষ্টেসৃষ্টে প্রতিটি ঘরেই লক্ষ্মীপূজা হতো-ই-হতো। তা যেন ছিল আমাদের গ্রামের হিন্দু সমাজে প্রায় বাধ্যতামূলক।

তখনকার সময়ে আমাদের মাহাতাবপুর গ্রামে আমাদেরই ছিল বেশি অভাব—মানে অভাবী সংসার। তখন ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। কারণ, আমার বাবা ছিলেন একজন চাকরিজীবী। তিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জ; চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা গ্রামসংলগ্ন আদর্শ কটন মিলে—গ্লাস ফ্যাক্টরিতে। তখনকার সময়ের টাকার যেমন দাম ছিল, শ্রমিকদের বেতনও ছিল যতসামান্য। বাবা বেতন যা-ই পেতেন, তা থেকে নিজের মাসিক খরচ রেখে বাকিটা বাড়িতে ডাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমার মাও বারো মাস বাবার পাঠানো টাকার আশাতেই থাকতেন। আমার বড়দাদাও বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জেই থাকতো। কিন্তু তখনো বড়দাদার পার্মানেন্ট চাকরি হয়নি। বড়দা টেম্পোরারি হিসেবে আদর্শ কটন মিলে উইভিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো। মাসে যা পেতো, তা বড়দার নিজেরই লেগে যেত। তাই বাবার বেতনের উপরই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা।

সে সময়ে ধর্মীয় উৎসবের আগমণে মিল কর্তৃপক্ষ মিলে তৈরি কাপড় থেকে বের হওয়া ‘রিজেক্ট’ কাপড়গুলো শ্রমিকদের মাঝে বিলি-বণ্টন করে দিতো—যাতে শ্রমিকরা ওইসব রিজেক্ট কাপড় দিয়ে নতুন জামাকাপড়ের কিছুটা চাহিদা মেটাতে পারে। দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হলেই আমার মা অপেক্ষায় থাকতেন বাবার আগমণের। মা আশায় থাকতেন—পূজো উপলক্ষে বাবা বাড়িতে এলে সাথে করে মিল থেকে পাওয়া সেই রিজেক্ট কাপড় নিয়ে আসবে; আর সেই কাপড় দিয়ে আমাদের লক্ষ্মীপূজার জামাকাপড় বানিয়ে দেবেন।

মায়ের আশা কোনো বছর পূরণ হতো, আবার কোনো বছর অপূর্ণ থেকে যেত। বাবা কোনো পূজায় ছুটি পেলে আসতেন, আবার কোনো কোনো পূজায় আসতেন না। কিন্তু আমার মা বাবার আগমণের অপেক্ষাতেই বেশি থাকতেন—মিলের সেই রিজেক্ট কাপড়ের আশায়। যদি বাবা পূজা উপলক্ষে সময়মতো নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসতেন, তাহলে বাবা সাথে করে আনা সেই রিজেক্ট কাপড় দিয়ে আমার মা সবার আগে আমার জন্যই শার্ট ও হাফপ্যান্ট নিজ হাতে সেলাই করে বানিয়ে দিতেন। কারণ আমি ছিলাম আমাদের অভাবী সংসারে সবার ছোট। তাই আমারটা থাকতো সবার আগে। এ নিয়ে আমার বড় তিন বোন কখনো টু-শব্দও করতো না—বরং তাঁরা এতে সবসময় খুশিই থাকতেন।

কোনও কারণবশত বাবা যদি পূজা উপলক্ষে বাড়িতে না আসতে পারতেন, তাহলে অন্তত এক-দেড় মাস আগেই চিঠি দিয়ে মা-কে জানিয়ে দিতেন। সে-বার আর নতুন জামা-প্যান্ট পেতাম না! ছেঁড়া-ফাটা পুরানো জামা-প্যান্ট পরেই পূজার আনন্দ উপভোগ করা হতো। কিন্তু লক্ষ্মীপূজা বাদ থাকতো না—যেভাবেই হোক, লক্ষ্মীপূজা হতো-ই-হতো।

প্রতিবারই লক্ষ্মীপূজাতে চিড়া-মুড়ির মোয়া তৈরি করার জন্য আমরা চার ভাই-বোন মিলে গ্রামের কৃষকদের ধানক্ষেতে ধান কুড়াতাম—হেমন্তে (কার্তিক ও অগ্রহায়ণ)। গ্রামের স্বচ্ছল কৃষকরা যখন ক্ষেতের পাকা ধান কাটতো, আমরা তখন তাঁদের পেছনে পেছনে থাকতাম ঝরে পড়া ধান কুড়াতে। এই দু’মাস কৃষকদের ধানক্ষেত থেকে ঝরা ধান কুড়িয়ে রেখে দিতাম লক্ষ্মীপূজার চিড়া-মুড়ির মোয়া বানানোর জন্য। দুর্গাপূজার শুরু থেকেই আমার মা ও তিন বোন মিলে সেই ধান থেকে চিড়া-মুড়ি তৈরি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন—ধান সিদ্ধ, ধান থেকে চাল, চাল থেকে চিড়া-মুড়ি; আর নাড়ু-সন্দেশ তৈরি হতো নিজেদের গাছের নারিকেল দিয়ে।

সে সময়ে আমার মতো ছোটো ছেলে-পেলেরা পূজা উপলক্ষে নতুন জামা-কাপড়, নাড়ু-সন্দেশ, চিড়া-মুড়ির মোয়ার চেয়ে বেশি খুশি থাকতো পূজার দিন ফটকা বা আতশবাজি ফোটাতে পারলে। কিন্তু আমাদের অভাবের কারণে গ্রামের আরও দশটা ছেলের মতো আমি ফটকা বা আতশবাজি ফোটাতে পারতাম না। লক্ষ্মীপূজার দিন গ্রামে পাশের বাড়ির ছেলেরা যখন সন্ধ্যাবেলা ফটকা বা আতশবাজি ফোটাত, তখন আমি মায়ের কাছে গিয়ে কাঁদতাম—আমাকে ফটকা এনে দেওয়ার জন্য। মা তখন সামনের লক্ষ্মীপূজায় ফটকা বা আতশবাজি কিনে দেবেন বলে শান্তনা দিয়ে রাখতেন। আমার কান্নাকাটি দেখে মা আর বড় দিদিরা বলতেন, “সামনের লক্ষ্মীপূজার আগেই তোর বাবাকে জানিয়ে দেবো, বাড়িতে আসার সময় যাতে তোর জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ফটকা বোমা, বাজি এসব কিনে নিয়ে আসে।” মায়ের কথা, বড় বোনদের কথা মেনে নিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে চুপ করে থাকতাম—সামনের লক্ষ্মীপূজার আশায়। এভাবে আশায় থাকতে থাকতে আরেক লক্ষ্মীপূজা শুরু হলেও আমার আর ফটকা ফুটানো কপালে জুটতো না; গ্রামের ছেলেদের ফুটানো ফটকার আওয়াজে নিজের ফটকা ফুটানোর স্বাদ মেটাতাম।

মায়ের আশ্বাসে নিরাশ হয়ে একবার এক লক্ষ্মীপূজা সামনে রেখে নিজেই প্রস্তুতি নিলাম—লক্ষ্মীপূজার দিন ফটকা ফোটানোর। লক্ষ্মীপূজার আগমণের কয়েক মাস আগে থেকে বাড়ির চারদিকে জন্মানো কচুর লতি-সহ সুপারি গাছ থেকে ঝরে পড়া সুপারি কুড়িয়ে হাটের দিন বড় জেঠার সাথে হাটে গিয়ে বিক্রি করতাম। সেগুলো বিক্রি করে যা দুই পয়সা পেতাম, সেই পয়সাগুলো রান্নাঘরের বাঁশের খুঁটির ভেতর জমা করে রাখতাম—উদ্দেশ্য, লক্ষ্মীপূজার দিন ফটকা ফুটানোর জন্য। সময়টা তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার এক বছর আগের কথা।

সেই লক্ষ্মীপূজার ঠিক চার-পাঁচ দিন আগে মায়ের কাছে বলেকয়ে জেঠাতো ভাইয়ের সাথে গেলাম চৌমুহনী টাউনে—উদ্দেশ্য, ফটকা বানানোর পটাসিয়াম (পটাস) ও গন্ধক কেনা। তখনকার সময়ের গ্রামের অনেকেই গন্ধক বেটে পাউডারের মতো করে পটাসের সাথে মিশিয়ে এক প্রকার ফটকা তৈরি করতো। এটা আমার জেঠাতো ভাইও পারতো। তাই আমি জেঠাতো ভাইয়ের সাথে পটাস ও গন্ধক কিনতে গিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিল মাত্র চার টাকা—তার মধ্যে দুই টাকার পটাস ও দুই টাকার গন্ধক। জেঠাতো ভাই কিনলো ১০ টাকার পটাস-গন্ধক। তারপর দু’জনে চৌমুহনী টাউন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম।

পটাসিয়াম ও গন্ধক বাড়িতে এনে সেগুলো নিয়ে খুশিতে নাচতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম—আর কয়েকদিন পর-ই তো লক্ষ্মীপূজা! এবার আমিও গ্রামের সব ছেলেদের শুনিয়ে দেবো ফটকার আওয়াজ; পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে দেবো ফটকার শব্দে! পরদিন জেঠাতো ভাইয়ের দেখাদেখি আমিও ফটকা (কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে বানানো বোমা) বানাতে লাগলাম! সাহায্য করলো জেঠাতো ভাই। বানালাম বেশ কয়েকটা ফটকা। লক্ষ্মীপূজা আর মাত্র দুই দিন বাকি।

কিন্তু এই দুই দিন যেন দুই বছরের সমান! দিন কাটে না—ফটকাও ফুটাতে পারছি না। মনের ভেতরে যে কী যন্ত্রণা—তা আর লেখা যায় না। বানানো ফটকা সাথে করেই খাওয়া-দাওয়া-ঘুমানো; চোখের আড়াল হতে দিই না—যদি কেউ নিয়ে যায় বা নষ্ট করে ফেলে! একসময় অপেক্ষার অবসান—রাত শেষে ভোরে লক্ষ্মীপূজার সূর্য উদিত হলো। লক্ষ্মীপূজার দিন গত সন্ধ্যা হতেই শুরু করে দিলাম ধুমধাম, ঠুসঠাস! শুধু আমি একাই নয়—আমার মতন গ্রামের অনেকেই যাঁর যাঁর বাড়িতে ফটকা ফুটাতেন। তখন পুরো গ্রাম নিজেদের বানানো ফটকার শব্দে কেঁপে উঠতো। এভাবে ঠুসঠাস চলতো রাতদুপুর পর্যন্ত।

এর পরের বছরই ১৯৭১ সাল—মার্চের শেষদিকে শুরু হলো মুক্তির যুদ্ধ! ৯ মাস তুমুল যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। এর এক বছর পর ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমরা সপরিবারে চলে আসি নারায়ণগঞ্জ। সেই থেকে আজ অবধি কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল! কিন্তু আজও আমার মন থেকে সেসব কষ্টের কথা, আনন্দের কথা মুছে যায়নি। এখনো প্রতিবছর দুর্গাপূজায়, লক্ষ্মীপূজায় অতীতের কষ্টের মাঝে আনন্দের স্মৃতিগুলো মনে জেগে ওঠে।

নিতাই বাবু এর ছবি
নিতাই বাবু

পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক – ২০১৭। লেখালেখির শুরু শৈশবে, এখনো চলছে।

মূলত সমাজ, সংস্কৃতি, স্মৃতিচারণা ও ছন্দনিবদ্ধ রচনায় আগ্রহী। ভাষার শুদ্ধচর্চা ও সাহিত্যসমৃদ্ধ বাংলার প্রতি অগাধ ভালোবাসা।

এই পোস্টটি পড়েছেন: 0 জন

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গাঁজা বা সিদ্ধি: ইতিহাস, উপকার ও ক্ষতি

এই পৃথিবীর একমাত্র সতী নারী হলো আপনার আমার গর্ভধারিণী মা