ঘুমের ঘোরে চাঁদের বুড়ির সাথে সাক্ষাৎ
স্বপ্ন কে না দেখে? স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্ন নিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে। নিজেও বেঁচে আছি স্বপ্ন দেখে! মানুষের মুখে অনেক শুনেছি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখার কথা। অনেক মানুষকে বলতে শুনেছি, “রাতে স্বপ্ন দেখলাম, আমেরিকা গিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করছি। সেই স্বপ্ন আমার ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই শেষ!”
আবার কেউ বলছিল, “রাতে স্বপ্নে দেখলাম, রাশিয়ার সাবমেরিনে চড়ে আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে গিয়ে মণিমুক্তা খুঁজছিলাম। হঠাৎ গিন্নির শরীরের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেলো। তারপর দেখি আমি আমার ছেঁড়া কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছি!”
মানুষের মুখে এমন হাজারো স্বপ্নের কথা বারংবার শুনেছি। মানুষের মতো প্রতি রাতে ঘুমের ঘোরে নিজেও অনেক স্বপ্ন দেখেছি। তবে অন্যসব মানুষের মতো নিজে কখনো সাবমেরিনে চড়ে মহাসাগরের তলদেশে যাইনি, নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো বলে। যদি সাবমেরিনে চড়ে পানির নিচে গায়েব হয়ে যাই, তাহলে আমার দুখিনী গিন্নি সারাজীবন আমার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে। তাই অসহায় গিন্নির কথা চিন্তা করে স্বপ্নে কখনো সাবমেরিনে চড়িনি। সাবমেরিনের স্বপ্ন কখনও দেখিওনি।
তবে হ্যাঁ, একবার নাসার মহাকাশযানে চড়তে চেয়েছিলাম। অত্যাধুনিক রকেটে চড়ে চাঁদের দেশে যেতে চেয়েছিলাম, চাঁদের বুড়ির সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের বুড়ির যুগ যুগ ধরে কাটা সুতাগুলো পাইকারি দরে কিনে আনার জন্য। একসময় এনিয়ে অনেক ভাবতাম!
এরকম ভাবনার পেছনে একটা কারণও ছিল বলা যায়। কারণ হলো, আমাদের দেশে এই কাটা সুতার প্রচুর চাহিদা আছে। এসব কাটা সুতাকে এদেশের কিছু ব্যবসায়ী ‘জুট’ বলে। সেই জুট থেকে মেশিনের সাহায্যে আবার তুলা তৈরি হয়। সেই তুলা দিয়ে লেপ-তোষক তৈরি করা-সহ নানারকম কাজে ব্যবহার করা হয়।
গার্মেন্টসের টুকরো কাপড়ের জুট থেকে বড়-বড় কাপড়ের টুকরাগুলো বাছাই করা হয়। সেগুলো বাজারে বিক্রি করা হয়। তারপর সেসব টুকরো কাপড় ক্রেতারা কিনে নেয়। সেগুলো দিয়ে ছোটদের জামা-প্যান্টসহ আরও অনেক কিছু তৈরি হয়। তাই বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক স্থানে এই জুটের জন্য সময়-সময় খুন-খারাবির মতো ঘটনাও ঘটে যায়। গার্মেন্টসের জুট আর টেক্সটাইল মিলের সুতার জুটের জন্য দলাদলি সৃষ্টি হয়! মহল্লায় মহল্লায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়! মারা-মারির সৃষ্টি হয়!
এসব জুট একসময় গার্মেন্টস-টেক্সটাইল মিলের মালিকরা ময়লা-আবর্জনার সাথে ফেলে দিতো। সেই ফেলে দেওয়া ময়লা-আবর্জনার জুট এখন লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশের শিল্পনগরী এলাকায় এই জুটের জন্য সিন্ডিকেটেরা বড় বড় নেতাদের পায়ে পায়ে ঘুরছে।
এসব দেখে মনে মনে ভাবতাম, “ইশ! যদি চাঁদের দেশে গিয়ে বুড়ির কাটা সুতাগুলো এদেশে নিয়ে আসতে পারতাম! তাহলে অনেক লাভ হতো, উপকারও হতো।”
প্রথমত: চাঁদের বুড়ি তো যুগ যুগ ধরে দিনের-পর-দিন, রাতের-পর-রাত সুতা কেটে বোঝাই করে রাখছে। এতে চাঁদের বুকে কাটা সুতা হয়ে যাচ্ছে পাহাড় সমান। এর কারণে দিন দিন রূপালি চাঁদটা কেমন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে যদি নামমাত্র মূল্যে সেগুলো কিনে আনতে পারতাম, তাহলে চাঁদের বুড়িও বেশ কিছু টাকা হাতে পেতো। সেইসাথে চাঁদের কিরণ আরও উজ্জ্বল দেখা যেত এবং চাঁদের ভারসাম্যও কিছুটা রক্ষা পেত।
দ্বিতীয়ত: চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে কাটা সুতাগুলো আমাদের দেশে আনতে পারলে এদেশে জুটের চাহিদা অনেকাংশে মিটে যেত। জুট নিয়ে খুনাখুনি, মারা-মারি, দলাদলি কম হতো। বড় বড় নেতারাও একটু আরামে ঘুমাতে পারতো। জুট ব্যবসায়ীদেরও ভালো ব্যবসা হতো।
তৃতীয়ত: চাঁদের বুড়ির থেকে নামমাত্র মূল্যে জুটগুলো কিনে এনে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলে বেশ কিছু টাকা লাভ হতো। সেই টাকা দিয়ে আমার মতো অনেক অভাবী সংসারের অভাব দূর হতো।
একদিন রাতের বেলা লেখালেখি বাদ দিয়ে এসব নিয়েই ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে ঠিকই চাঁদের দেশে চলে গেলাম। চাঁদের দেশে গিয়ে রোবট সাজে রকেট থেকে নেমে যখন চাঁদের বুড়ির সামনে গেলাম, তখন চাঁদের বুড়ি তেড়ে এসে আমার দুই গালে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞেস করলো, “তুই না নেহাত গরিব মানুষ? গরিব হয়েও নাসার মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবী থেকে এখানে আসলি কেন?”
চাঁদের বুড়ির প্রশ্নের জবাবে আমি দু’কান ধরেই বললাম, “বুড়ি মা, আমি তো আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আগে আপনার দু’পা ছুঁয়ে নমস্কার করে নিই, তারপর না হয় এখানে আসার উদ্দেশ্যটা বলি।”
আমার কথা শুনে চাঁদের বুড়ি বললো, “নমস্কার লাগবে না। তুই আমাকে ছুঁতেও পারবি না। তোর সাথে নানারকম প্রাণঘাতী ভাইরাস আছে। তুই আমাকে ছুঁলে আমিও সেসব ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়বো। যা বলার অন্তত তিন ফুট দূরে থেকেই বল! বল, তোর উদ্দেশ্যটা কী?”
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, “বুড়ি মা, আমি আপনার কাটা সুতাগুলো পাইকারি দরে কিনতে এসেছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আপনার সুতা কাটার কৃতিত্বের কথা। তাই ভাবলাম, আপনার কাটা সুতাগুলো পৃথিবীতে এনে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দিবো। এতে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদেরও জুটের চাহিদা মিটবে, আর আমার সংসারে লেগে থাকা অভাবও কিছুটা দূর হবে।”
এই কথা বলার পরই চাঁদের বুড়ি আমাকে আরেকটা জোরে থাপ্পড় দিয়ে আমার এক কানের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলো। (সেই থেকে আমি শ্রবণশক্তিহীন)। তারপর বললো, “তুই কি বোকা? এখানে কি কোনো সুতা তৈরির ফ্যাক্টরি আছে? আমার কি খেয়ে-দেয়ে আর কাজ নেই? আমি কি বসে বসে শুধু সুতাই কাটবো? বোকা কোথাকার!”
আমি বললাম, “তাহলে বুড়ি মা, আমি যে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আপনি একটা বটগাছের নিচে বসে বসে যুগ যুগ ধরে শুধু সুতাই কাটছেন! এটা কি আমি ভুল শুনেছি?”
আমার কথা শেষ হতে না–হতেই চাঁদের বুড়ি আমাকে আরেকটা থাপ্পড় মারতে চাইলো। তা দেখে আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। থাপ্পড় আর আমার গালে লাগলো না। তৃতীয় থাপ্পড় থেকে রক্ষা পেলাম! তারপর চাঁদের বুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বললো, “আমি এখানে আছি চাঁদকে দেখে রাখার জন্য, যাতে রাহু চাঁদকে গিলতে না পারে। আমি হলাম চাঁদের মা বুড়ি। কোটি কোটি বছর ধরে আমি চাঁদকে পাহারা দিয়ে রাখছি। তুই যা এখান থেকে!”
এই বলেই আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে চাঁদ থেকে নিচে ফেলে দিলো। আমি সেদিন বায়ুমণ্ডলে যে কতক্ষণ ঘুরেছি, তা বলতে পারবো না। হয়তো বায়ুমণ্ডলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঠুস করে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালের ছাদের উপরে পড়েছিলাম। তারপর হয়তো সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আমাকে উদ্ধার করে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমি আমার ঘরে ভাঙা খাটের উপরই শুয়ে আছি!
![]() |
নিতাই বাবু
পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক – ২০১৭। লেখালেখির শুরু শৈশবে, এখনো চলছে। 🌐 ব্লগ: নিতাই বাবু ব্লগ | জীবনের ঘটনা | চ্যাটজিপিটি ভাবনা |
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com